মুন্সীগঞ্জে ৫ লাশ উদ্ধার, তিন হত্যাকা-ের মধ্যে যোগসূত্র পরিবারের দাবি গুপ্তহত্যা by মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল

বৃহস্পতিবার মুন্সীগঞ্জে মাথায় গুলিবিদ্ধ তিন ব্যক্তিসহ ৫ লাশ উদ্ধার হয়েছে। চোখে এবং দু’হাত পেছনে নিয়ে নতুন গামছাবাঁধা এবং গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা তিন লাশ নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ব্রিজের নিচে দুটি ও শ্রীনগর উপজেলার শ্রীধরপুর রাস্তার পাশ থেকে অপর লাশটি উদ্ধার করা হয়। পৃথক স্থান থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার সম্পর্কে গুলির ধরন দেখে পুলিশ মনে করছে তিনটি হত্যাকা-ের মধ্যেই যোগসূত্র রয়েছে এবং বুধবার গভীর রাতে অন্যত্র হত্যার পর লাশ ফেলে রেখে যায়। পরিবারের লোকজনের দাবি এগুলো গুপ্ত হত্যা। মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান বলেন, অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসবে হত্যার মূল কারণ। গুলিবিদ্ধ তিন যুবকের হত্যাকা-ের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত রয়েছে পরিবারের এমন অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে এমনটা মনে করছি না। তদন্তেই বেরিয়ে আসবে সঠিক ঘটনা।’
সকাল ৯টার দিকে রশুনিয়া বেইলি ব্রিজের নিচে উদ্ধার করা প্রথম মৃতদেহটি হচ্ছে- মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের খোরশেদ আলমের পুত্র মোঃ ইব্রাহীমের (২০)। তার মাথায় তিনটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। তার গলায় একটি নতুন গামছা বাঁধা ছিল। ইব্রাহিম ঢাকার পূর্ব জুরাইনে তার মামা আব্দুস ছাত্তার মিয়ার বাড়িতে থাকত। গত ১৬ জানুয়ারি কাতার যাওয়ার জন্য ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বনানী যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় সে। নিখোঁজের পর দিন ১৭ জানুয়ারি তার মা নাজমা বেগম ঢাকার কদমতলী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরি নং ৮৯৯। মামা আব্দুস ছাত্তার জানান, নয়াবাজারের আবুলের গ্রিলের দোকানে কাজ করত। ইব্রাহিমের বাবা কুয়েত প্রবাসী। বর্তমানে ছুটিতে দেশে এসে বড় পুত্রের এমন মৃত্যুর খবরে তিনি পাগলপ্রায়। দু’ ভাইয়ের মধ্যে ইব্রাহিম বড়। ছোট ভাই ইয়াসিন ঢাকার জুরাইনে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ইব্রাহিমের মামা নাসির মিয়া ও আব্দুস ছাত্তার আশঙ্কা করে বলেন, আমার ভাগ্নে কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না, কিন্তু গুম করার পর পরিকল্পিতভাবে কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করা হয়েছে। সিরাজদিখান থানার ওসি শেখ মোঃ মাহাবুবুর রহমান জানান, থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকার কদমতলী এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল হত্যা মামলার আসামি ছিলেন ইব্রাহিম। একই মামলায় আটক সজীব পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইব্রাহিমের নাম প্রকাশ করে। তবে ইব্রাহিম কী ভাবে মারা গেছে পুলিশ তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
রশুনিয়া বেইলি ব্রিজের অদূরে বেলা সাড়ে ১১টায় উদ্ধার করা হয় আব্দুল কুদ্দুসের (৪২) মাথায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ লাশ। কেরানীগঞ্জের আম বাগিচা গ্রামের বাসিন্দা কুদ্দুস মাদারীপুর জেলার গোগলী গ্রামের আব্দুল খালেক ব্যাপারীর পুত্র। আব্দুল কুদ্দুসের বড় ভাই সারোয়ার হোসেন জানান, ১৪ দিন ধরে তার ভাই নিখোঁজ ছিল। কেরানীগঞ্জের আম বাগিচার পানাকা মার্কেটের মিনি গার্মেন্টসের মালিক ছিল তার ভাই। দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার পথে ১১ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে সে নিখোঁজ হয়। কুদ্দুস তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার স্ত্রী সোহাদা বেগম এখন পাগলপ্রায়।
রশুনিয়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগরের উপজেলার শ্রীধরপুর সড়কের ধারে বেলা সাড়ে ১২টায় মাসুদ ওরফে রাঢ়ী মাসুদের (৩২) লাশ উদ্ধার করা হয়। সে ঢাকার কেরানীগঞ্জের আম বাগিচা গ্রামের মিজান খানের পুত্র। তার ¯েœহা নামের আড়াই বছরের এক কন্যাসন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী শায়লা বেগম স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা। মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে লাশ শনাক্তের পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাঁর ভাবি নুরজাহান বেগম। তিনি জানান, বাসা থেকে পোস্তগোলায় পাওনা ২০ হাজার টাকা আনতে গিয়ে সে নিখোঁজ হয় ১১ জানুয়ারি বিকেলে। সে ঢাকার সোয়ারি ঘাটের খেয়াপাড়াপারে টোল আদায় করত। নুরজাহান বেগম আরও জানান, রাঢ়ী মাসুদের জমির একটি প্লট বিক্রি করেছিলেন নাজমূল নামের এক ব্যক্তির কাছে। তিনি একতলা ভবন তৈরি করেন। কিন্তু রাঢ়ী মাসুদের বেশি জমি দখল করায় বাড়িভাড়া তুলে নিতেন রাঢ়ী মাসুদ। এই নিয়ে নাজমূলের সঙ্গে বিরোধ ছিল। নাজমূল অতিরিক্ত জমি বাবদ ২০ হাজার টাকা দিবেন শুনে সে টাকা আনতে পোস্তগোলায় রওনা হন বলে জানান তিনি।
শ্রীনগর থানার ওসি মোঃ মিজানুর রহমান জানান, স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করা হয়। স্বজনরা লাশ শনাক্ত করেছে। তবে ৩টি হত্যার সঙ্গেই যোগসূত্র রয়েছে। তবে কীভাবে হত্যাকা- ঘটেছে তা নিশ্চিত করা যায়নি। রাঢ়ী মাসুদের মাথায় ও গলায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া ২টি নতুন গামছা দিয়ে তার চোখ বাঁধা ছিল।
এদিকে সিরাজদিখান উপজেলার শিয়ালদি গ্রামের নিজ বাড়ির লিচু গাছ থেকে আল আমিন (৩৫) নামের এক ব্যক্তির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সে মোকলেছ চৌকিদারের পুত্র। পারিবারিক সূত্রের বরাত দিয়ে সিরাজদিখান থানার ওসি জানান, বাবার সঙ্গে অভিমান করে রাতে নিজের মাফলার গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ দেখা যায়। দু’সন্তানের জনক আল আমিন আত্মহত্যা করেছে নাকি হত্যা করা হয়েছে তা নিরূপণে লাশটি উদ্ধার করে বৃহস্পতিবার সকালে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এনে স্ত্রী শিরীন আক্তারের (২০) লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে স্বামী। টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দিঘিরপাড় ইউনিয়নের সরিষাবন গ্রামের নূর আলম স্ত্রী শিরীন আক্তারকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় এক প্রতিবেশীসহ মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় তাঁর স্বামী নূর আলম শিরীনের লাশ হাসপাতালে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। শিরিনের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। সদর থানার ওসি আবুল বাশার জানান, মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জে এমন লাশ উদ্ধারের ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটছেÑ এই জেলাকে কি অপরাধীরা ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘ঠিক এমনটা নয়, অন্যান্য স্থানেও লাশ পাওয়া যায়। তবে মুন্সীগঞ্জের ওপর দিয়ে দুটি হাইওয়ে ও নদী পথ থাকায় এটা হচ্ছে।
অপর ২টি লাশ উদ্ধারের ব্যাপারে তিনি বলেন, যথাযথ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.