বাচ্চু রাজাকার মামলার রায় ॥ ইতিহাসের অধিকার ফিরে পাওয়া by মুনতাসীর মামুন

এ রকম একটি দেশে, যে দেশে বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা বলে কিছু নেই, সে দেশে মানবতা [যুদ্ধাপরাধ] বিরোধী অপরাধের বিচার হবে সে কথা কেউ ভাবেনি।
অবশ্য, বলতে পারেন, যেখানে সত্য-মিথ্যার ধার ধারে না কেউ, সে রকম দেশেই হয়ত এটি সম্ভব। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী ও খুনীদের সমর্থনকারী বিএনপি স্বপ্নেও ভাবেনি যে, এরকমটি হতে পারে বা হবে। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি।
আলবদর নিজামী একবার এক টিভি সাংবাদিককে আলোচনার জন্য বাসায় আসতে বলেছিলেন। তিনি গিয়েছিলেন। আলোচনার পর নিজামী তাকে খেয়ে যেতে বললেন। সাংবাদিক রাজি হলেন না। ঠা-া পানীয় অফার করলেন। তাও তিনি গ্রহণ করলেন না। নিজামী বললেন, আপনি কি আমাকে ঘৃণা করেন? দেখেন, আগামী ১৫ বছর পর আমরাইÑএই জামায়াতে ইসলামীই সব নিয়ন্ত্রণ করবে, বিএনপিও থাকবে না। সাংবাদিক যে কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বলতে পারেননি ভয়ে, তা’ হলো, আলবদর আবার মানুষ হলো কবে? আর জামায়াত যখন সব নিয়ন্ত্রণ করবে তখন দেশত্যাগ করব।
নিজামীর কথা কিছুটা হলেও ফলেছে। জামায়াত ক্ষমতায় এসেছিল। বিএনপি আছে; এখন তারা জামায়াতের কমান্ড কাউন্সিলের অধীন। এদের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা বিএনপির কারও, এমনকী খালেদা জিয়ারও নেই। কিন্তু, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বদলে জামায়াত নেতারা জেলে থাকবেন সেটি বোধহয় তাদের কল্পনায়ও ছিল না। জামায়াত-বিএনপি কি ভেবেছিল, যুদ্ধাপরাধ বিচার করার কথা? দেশটাকে তো তারা হাফ পাকিস্তান বানিয়ে ফেলেছে। সেখানে আবার কে এই বিচার করবে? ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর বিষয়টি তারা সিরিয়াসলি নেয়নি। বিচার শুরু হওয়ার পরও ভেবেছে, আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ধরে এ বিচার চালাবে [ট্রাইব্যুনাল সরকারের কথামতো চলে না এ ধারণা কারও নেই] নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য। কিন্তু, নির্বাচনে তো তারা আসবে না। সুতরাং এসব ট্রাইব্যুনাল তখন থাকবে না। বেগম জিয়া তো নাকি ঘোষণা করেছেন ক্ষমতায় গেলে এসব বিচার-টিচার হবে না। কিন্তু, বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে রায় হয়ে যাবে এটি তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। যুদ্ধাপরাধীদের দু’টি দলের নেতাদের বক্তৃতায় বিষয়টি স্পষ্ট। নতুন কোন বক্তব্য তারা দেননি। আশঙ্কা করা হয়েছিল, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ অনেক কিছু হতে পারে। কিছুই হয়নি।
অন্যদিকে এই রায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের উজ্জীবিত করেছে। মিছিল হয়েছে, কোলাকুলি, মিষ্টি খাওয়া হয়েছে। ৪০ বছরের সংগ্রামে হঠাৎ রায় এক ধরনের অবসাদও এনে দিয়েছে অনেকের মনে। আনন্দাশ্রু অনেকের চোখে। মৃত্যুর আগে খুনীদের বিচার দেখে যাওয়া যাবে এটি অনেকেই ভাবেননি। সবাই আশা করছেন, দ্রুত আরও কিছু রায় হবে; তারপর দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ আপীলে যাবে এবং তারপর তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ রায় কার্যকর হবে।
এ রকম ভাবনাÑ চিন্তার কারণ কী? কারণ আর কিছুই না, দায়মুক্তি। বাংলাদেশে দায়বদ্ধতার বদলে দায়হীনতা বা দায়মুক্তির বিষয়টি শুরু হয়েছে জেনারেল জিয়ার আমলে। শুধু শুরু হয় তিনি সেটা ভালভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন। জামায়াতীদের মুক্তি দিয়ে, রাজনীতি করতে দিয়ে, ক্ষমতায় বসিয়ে। একই কাজ করেছেন তার শিষ্য এরশাদ ও তার পতœী খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয়, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাকে যারা খুন করেছিল তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় পদ দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পৃথিবীর কোন দেশে এরকম অভাবনীয় ও জঘন্য কা- কেউ ঘটায়নি। সভ্য দেশে কেউ ভাবতে পারে না যে, হত্যাকারীর বিচার হবে না। শুধু তাই নয়, মারাত্মক যে কা-টি করা হয়েছিল তা’হলো, সংসদে আইন করে খুনীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল।
এর অর্থ সামরিক শাসকরা এ বার্তা দিতে চেয়েছেন জামায়াত ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুনর্বাসন করে যে, খুন করা ধর্ষণ করা লুট করা অগ্নিসংযোগ করা, এথনিক ক্লিনজিংÑ কোন কিছুই অপরাধ নয়। জিয়া তো এ পথে এসেছিলেন, এরশাদও। আর স্বামীর দল বিএনপির কা-ারী খালেদা জিয়া তো এর বাইরে যেতে পারেন না। সমাজে এভাবে ভায়োলেন্স ছড়িয়ে দিয়েছিল এই দায়হীনতা। রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে রাজনীতিতে যাওয়ার জন্য ওই খুনীদের ব্যবহার শুরু করে, রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। এর উদাহরণ জিয়াউর রহমানের আমল থেকে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতা দখলের জন্য সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন ক্যু, জামায়াত-বিএনপি আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলা, জঙ্গীদের প্রশ্রয় দান। বাংলাদেশকে খুনীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন জেনারেল জিয়া।
বিচারহীনতা থেকে বিচারমুখিতার দিকে প্রথম পদক্ষেপ নেন শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে। ইনডেমনিটি বাতিল করা হয়, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে দেয়া রায় কার্যকর হয়। এবারও, আগেই বলেছি, এই রকমটি হবে কেউ ভাবেনি। কিন্তু হয়েছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, মুজিবুর রহমান মিঞা ও শাহীনুর ইসলাম প্রদত্ত রায়ে বিচারমুখিনতা ও দায়হীনতা বন্ধের প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এ সংস্কৃতি চলতে পারে না; কারণ, বিচার না হওয়া দেশের রাজনৈতিক এবং পুরো জাতির মনস্তত্ত্বে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। এই দায়হীনতা সৃষ্টি করেছিল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার এবং ধ্বংস করেছিল শাসনতন্ত্র।
“[ঞযব ঢ়বৎঢ়বঃৎধঃড়ৎং ড়ভ ঃযব পৎরসবং পড়ঁষফ হড়ঃ নব নৎড়ঁমযঃ ঃড় নড়ড়শ ধহফ ঃযরং ষবভঃ ধ ফববঢ় ড়িঁহফ ড়হ ঃযব পড়ঁহঃৎুদং ঢ়ড়ষরঃরপধষ চংুপযব ধহফ ঃযব যিড়ষব হধঃরড়হ. ঞযব রসঢ়ঁহরঃু ঃযবু বহলড়ুবফ যবষফ নধপশ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ংঃধনরষরঃু ংধি ঃযব ধংপবহফ ড়ভ সরষরঃধহপু ধহফ ফবংঃৎড়ুবফ ঃযব হধঃরড়হং পড়হংঃরঃঁঃরড়হ.]”
আমরা অনেকবার বলেছি, জামায়াতী সংস্কৃতির কারণেই দেশে মৌলবাদ জঙ্গীবাদের সৃষ্টি এবং বিকাশ। কারণ, জঙ্গীদের অধিকাংশ জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও জামায়াতী দর্শনে বিশ্বাসী এবং তারা দেখেছিল গণহত্যা, গণধর্ষণ, গণঅগ্নিসংযোগ, গণলুটপাটে কোন শাস্তিই হয় না, বরং ক্ষমতায় যাওয়া যায়। এই প্রত্যয় গত প্রায় চার দশক বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে গেঁথে দেয়া হয়েছে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এটি যথেষ্ট। বিএনপি-জামায়াত তো বাঙালীদের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়নি। তারা চেয়েছে এবং চাইছে পাকিস্তানবাদের প্রতিনিধিত্ব করতে। বাঙালী জাতীয়তাবাদের রেশ খানিকটা থাকলেও এটি সম্ভব হবে না। সেজন্য তারা বাঙালী প্রত্যয় ধ্বংসের জন্য এ প্রত্যয় চেয়েছে। সংবিধানও বিনষ্ট করতে চেয়েছে; কারণ, ১৯৭২ সালের সংবিধান বাঙালী জাতি ও রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব ধারণ করে। যে কারণে জিয়াউর রহমান প্রথমে এসেই ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিকত্ব বিনষ্ট করলেন। মুক্তিযুদ্ধ বদলে করলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিচারকরা বিশেষভাবে দায়হীনতার উল্লেখ করেছেন। এই রায়/বিচার সমাজে বিচারহীনতা থেকে বিচারমুখিনতা সৃষ্টি করবে। এই রায় বাঙালীর মৌলিকত্ব ঘোষণা করে ইতিহাসে আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশী শব্দ সংবিধানে প্রোথিত করে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে আমাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন।
এই বিচারহীনতার কী ভাবে প্রভাবিত করে মনস্তত্ত্ব? ২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় তখন ১৯৭১ সালের মতো বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন নেমে এসেছিল; জেল, হত্যা, ধর্ষণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল এবং এথনিক ক্লিনজিং শুরু হয়েছিল। আমি জানি না কেন আমরা ইতিহাসের সূত্রগুলো ভুলে যাই। মাহফুজ আনাম খুব সুন্দরভাবে একটি বাক্যে লিখেছেনÑ বঙ্গবন্ধু-উত্তরকালে আমাদের সংগ্রামের সাংস্কৃতিক দিকটি কখনও আমাদের মনস্তত্ত্বে¡ আসেনি।
[“ঞযব পঁষঃঁৎধষ ধংঢ়বপঃ ড়ভ ড়ঁৎ ংঃৎঁমমষব হবাবৎ ড়পপঁঢ়রবফ ধহু ঃযরহশরহম ড়ভ ঃযব ঢ়ড়ংঃ-ইধহমধনধহফযঁ ৎবমরসবং.”]

॥ চার ॥

এই রায়ের একটি পরোক্ষ দিক বিবেচনায় আনা বাঞ্ছনীয়। ১৯৭১ সালের বিভিন্ন দিক যারা অস্বীকার করেছে তারা ইতিহাসকে অস্বীকার করছে। সবচেয়ে বড় কথা, যারা অপরাধী তাদের যারা কারাগার থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসায় তারাও তো অপরাধী। অর্থাৎ জিয়া যখন জামায়াতকে অবমুক্ত করেন, আলবদর রাজাকারদের ক্ষমতায় বসান তখন তো তিনি এক ধরনের অপরাধই করেন। এরশাদও একই কাজ করে অপরাধ করেন। খালেদা জিয়া অপরাধী ব্যক্তিকে নয়, অপরাধী দলটিকেই ক্ষমতায় আনেন সেটি তো আরও অপরাধ। বিচারহীনতা বা দায়হীনতার বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নেয়া যায়। বঙ্গবন্ধুকে যারা খুন করল সেই আত্মস্বীকৃত খুনীদের জিয়া-এরশাদ-খালেদা রাষ্ট্রীয় পদে আসীন করে বিদেশ পাঠালেন, সংসদ সদস্য করলেন। যেই তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হলো তার হত্যাকারীদেরও জিয়া এরশাদ খালেদা সমর্থন করলেন। বেগম জিয়া ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন ঘোষণা করলেন। মনে হলো, তিনি বঙ্গবন্ধুর রক্তে স্নান করে তৃপ্ত হলেন। দেখুন, দায়হীনতা মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়
স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় এই যে কা-গুলো হলো তাতে জাতি লজ্জিত হলো না। এদেখে একবার লিখেছিলাম, এক অনিচ্ছুক জাতিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা জিয়ার অনুসারী হলেন, বামপন্থীরা অনুগামী হলেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন ১৯৭২ সালে জামায়াতের দালালদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আদালতে মামলা লড়েছেন। এখন খালেদা জিয়ার নির্দেশে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে লড়ছেন। দায়হীনতা এভাবে নির্লজ্জতার সৃষ্টি করে। আমরা যে দীর্ঘদিন বিচারহীনতা ও দায়হীনতাকে সমর্থন করেছি সেজন্য আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত।
মাহফুজ আনাম আরও বিস্তারিতভাবে লিখেছেন, এই নির্লজ্জতা হচ্ছে সমষ্টিগত লজ্জা বা ‘কালেকটিভ’ শেম। তিনি লিখেছেন, এভাবে পরিকল্পিতভাবে মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধু ও ঐ আমলের নেতৃত্বকে তারা মুছে ফেলতে চেয়েছে। এমন একটা সময় ছিল যখন আমরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী না বলে হানাদার বাহিনী বলেছি। যে বিষয়টি আগে উল্লেখ করেছি, রায়েও বলা হয়েছে, সেটি মাহফুজও বলছেন, আমাদের সংগ্রামের গুরুত্ব ও বিস্তৃতি সচেতনভাবে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। এর কারণটি তারা উল্লেখ করেননি; কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সংগ্রামের গুরুত্ব দিলে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের নায়ক হয়ে ওঠেন। একজন মেজরের সেখানে স্থান কোথায়?
এই রায় পরোক্ষভাবে ঘোষণা করেছেÑ অপরাধীকে অবমুক্ত করে, প্রশ্রয় দিয়ে ঐ তিনজন অপরাধ করেছেন। আর কিছু না হোক, নৈতিক মানদ-ে তো তারা দায়ী বা অপরাধী। এই রায়ের এটিই গুরুত্বপূর্ণ দিক।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.