সর্বজন শ্রদ্ধেয় চিকিসা বিশেষজ্ঞ by ডা. নূরুল ইসলাম, নিয়ামত হোসেন

কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা নিজেদের জীবদ্দশায় শুধু নিজেদের ক্ষেত্রেই নয়, তার বাইরেও বৃহত্তর পরিসরে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ডা. নূরুল ইসলাম তাঁদেরই একজন।
তাঁর নিজের ক্ষেত্র চিকিৎসা। সেদিক থেকে নানা পর্যায়ের অগণিত মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর যোগাযোগ বা পরিচয়। অগণিত মানুষ তাঁকে চিনত। বিশেষ করে অগণিত রোগী চিকিৎসার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতো। তাঁর চিকিৎসা পেয়েছেন যাঁরা তাঁরা অসুখবিসুখে তো বটেই, অসুখবিসুখ না হলেও মনে করতেন তাঁর কথা। স্মরণ করতেন তাঁর চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। তাই তাঁর খ্যাতির পরিসরও বিরাট। এমন একটা সময় ছিল যখন দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক বলতে ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন ডা. নূরুল ইসলাম। চিকিৎসা সূত্রে তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন যেমন অনেক বিশিষ্ট মানুষ, তেমনি এসেছেন সাধারণ অনেকেই। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করছেন। একজন ভাল তথা দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেক কিংবদন্তিতম হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
তাঁর খ্যাতি ছিল সর্বমহলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর চিকিৎসা করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন তিনি। তিনি চিকিৎসা করেন সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির। পল্লীকবি জসীম উদদীন, কবি সুফিয়া কামাল, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন প্রমুখের চিকিৎসা করেছেন। এমনি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অপরাপর অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয় কবি কাজী নজরুলের চিকিৎসার বিষয়। ডা. নূরুল ইসলাম কবি নজরুলেরও চিকিৎসা করেছেন।
দেশে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মেডিক্যাল শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। পিজি তথা চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তিনি প্রায় শূন্য অবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠা ও চালু করেছেন।
দেশে মেডিক্যাল শিক্ষার বিস্তার ঘটুক, সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য ও রোগব্যাধি সম্পর্কে সচেতন হোক এই চেষ্টা ছিল তাঁর। এ ব্যাপারে উল্লেখ করা যায় জাতীয় যক্ষ্মা সমিতি গড়ে তোলার কথা। কয়েক বন্ধুকে নিয়ে তিনি ঐ সমিতি গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে ‘আধূনিক’ প্রতিষ্ঠা। এটি শুধু কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নয়, এটি একটি আন্দোলন। আধূনিক অর্থাৎ আমরা ধূমপান নিবারণ করিÑএই সেøাগানের মাধ্যমে তিনি ধূমপানের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলেন; সবার সামনে তুলে ধরেন ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো।
দেশে প্রথম ওষুধনীতি তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই নীতি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়।
মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায় সমস্যায় পড়ে, বিপদের সময়। রোগব্যাধি হলে তখন যেতে হয় ডাক্তারের কাছে। নিজের হলে বা নিজের পরিবারের কারও অসুখ হলে চিকিৎসকের কাছে যায়। যাঁর কাছে চিকিৎসা নিলে দ্রুত ভাল ফল পাওয়া যায় তাঁর কথা মানুষ মনে রাখে। পরবর্তী সময় সে ফলের কথা অন্যদের কাছে বলে। এর সঙ্গে আরেকটি দিক রয়েছে। কে কত কম ওষুধ দেন বা কম পরীক্ষার পরামর্শ দেন সেটাও রোগী বা রোগীর লোকেরা বিবেচনায় নেয়। দেশের অনেক চিকিৎসকই সাধারণত কম ওষুধ দেন এবং সাধারণ অসুখে একগাদা পরীক্ষার পরামর্শ দেন না। ডা. নূরুল ইসলাম ছিলেন এমনই একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক, সাধারণ কোন অসুখে ওষুধ কম দেয়ার ব্যাপারে যাঁর খ্যাতি রয়েছে। জানা যায়, খুব প্রয়োজন না হলে পারতপক্ষে তিনি কখনই একগাদা ওষুধ দিতেন না। এমনকি ছোটখাটো অসুখ, যেমন সর্দি-কাশি হলে তিনি নাকি কাশির সিরাপের বদলে কুসুম কুসুম গরম পানি খাওয়ার পরামর্শ দিতেন।
স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং রোগব্যাধির ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করুক সবাইÑএটাই চাইতেন তিনি। এজন্যই ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ‘আধূনিক’ গড়ে তুলেছিলেনÑযা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তিনবার বিশেষ পদক দিয়েছে তাঁকে। এটা তাঁর জন্য সম্মান তো বটেই, দেশের জন্যও বিরাট সম্মানের ব্যাপার।
ডা. নূরুল ইসলাম দেশে শুধু চিকিৎসার প্রসারই নয়, চিকিৎসা বিষয় নিয়ে নতুন নতুন গবেষণার ব্যবস্থাও করতেন। এ কাজটিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কম নয়।
তিনি ছিলেন বিশিষ্ট অভিজ্ঞ চিকিৎসক। চিকিৎসা শিক্ষা সম্প্রসারণের এবং চিকিৎসা গবেষণা ক্ষেত্রের একজন উদ্যমী মানুষ, একজন দক্ষ সংগঠক। তাঁর মতো মানুষের চলে যাওয়া দেশের জন্য বিরাট ক্ষতির। তাঁর অভাব সহজে পূরণ হবে না।
অনেক কাজ করেছেন তিনি। চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছেন। এই কাজগুলোর মধ্যেই মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে, মনে রাখবে।

No comments

Powered by Blogger.