মধ্যপ্রাচ্য-মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যই ইসরায়েলের শক্তি by গওসল আযম

মধ্যপ্রাচ্যের রাজশক্তি এবং স্বৈরশক্তি ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করতে যতই পরাশক্তির পদলেহন করুক; জনগণ ততই বহির্বিশ্বের সংস্পর্শে আসছে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন, শিক্ষার সম্প্র্রসারণ মানুষকে অধিকার সচেতন করে তুলেছে।
সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে তারা বুঝতে শিখেছে যে, তাদের একতাবদ্ধ অমোঘ শক্তির কাছে যে কোনো পরাশক্তি হার মানতে বাধ্য। তাদের এই চেতনাকে যাতে কার্যে রূপান্তর করা না যায়, তার জন্য সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো তাদের কূটবুদ্ধি, সম্পদ, প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটিয়ে দেশে দেশে এবং একই দেশের মানুষের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ চালিয়ে নিত্যনতুন গণবিধ্বংসী অস্ত্রের আবিষ্কার করে চলেছে। আবার এসব অস্ত্রের বিক্রি হচ্ছে বিবদমান রাষ্ট্রগুলো বা জনগণের কাছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কূট দর্শন সম্পর্কে বৈশ্বিক জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ওয়াকিবহাল হলেও, তারা অর্থবহ কিছুই করতে পারছে না তাদের চালিকাশক্তির সীমাহীন লোভ ও ক্ষমতাগৃধ্নুতার কারণে।
মধ্যপ্রাচ্যে গণমানুষের স্বার্থ দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে উপেক্ষার অন্যতম ফসল আরব বসন্ত। যদিও আরব বসন্তের সোনালি ফসলের ভাগ সাধারণ মানুষের ঘরে তেমন একটা যায়নি বা যেতে দেওয়া হয়নি, তথাপি এর ফলে মানুষের একতাবদ্ধ হওয়ার আওয়াজ ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আর তার স্লোগান হচ্ছে ইহুদি শক্তির অব্যাহত দানবিক শক্তির নাগপাশ থেকে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমে প্রতিষ্ঠা করা। এ দাবির প্রতি পরাশক্তিগুলো বহুদিন ধরে কর্ণপাত না করলেও, এখন কর্ণপাত করার সময় এসেছে বলেই ফিলিস্তিনকে ২০১২-এর ২৯ নভেম্বর সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদাপ্রাপ্তির আগের ৩য় সপ্তাহে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ২১ নভেম্বর মিসরের মধ্যস্থতার মাধ্যমে। এই যুদ্ধে বিভিন্ন মতাবলম্বী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কিছুটা একতার লক্ষণ দেখা গেলেও, যুদ্ধবিরতি এবং পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদাপ্রাপ্তির পর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আবার অনৈক্যের বিষবাষ্প পশ্চিম তীর এবং গাজার বাতাস দূষিত করছে। ইসলামপন্থি হামাস দল ২০০৭ সাল থেকে গাজার ওপর কর্তৃত্ব করে আসছে এবং সর্বশেষ যুদ্ধের পর তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে যে মাহমুদ আব্বাস পশ্চিম তীরে কর্তৃত্ব করছেন, তার প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। হামাস আর ফাতাহ্-এর আব্বাসের বিভিন্নতাকে আরও বিশৃঙ্খল করছে হামাসের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দল।
গাজার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়ে খালেদ মিশালের বিপক্ষ সিরিয়ায় নির্বাসনে থেকে আন্দোলন পরিচালনা করতেন। তিনি গাজায় ফিরে এসে তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন। ২০১২-এর নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের যুদ্ধের পর হামাসের সামরিক দফতরের কাশেম ব্রিগেড ফিলিস্তিনের উভয় অংশে সমাদৃত হচ্ছে। এবারই ফিলিস্তিনি শক্তি ইসরায়েলের কেন্দ্রভূমি তেলআবিব এবং জেরুজালেমের সনি্নকটে রকেট হামলা পরিচালনার ফলে ২০০৪ সালের পর এই প্রথম ৩০ ইসরায়েলি নিহত হয়। সাধারণ অধিবাসীরা হয় আতঙ্কিত। বেশ কয়েক দিন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছে। স্লোগান ছিল পশ্চিম তীর ফাতাহ্ এবং হামাস গাজার ওপর কর্তৃত্ব করুক। তার পর উভয়ের পার্থক্য দূর করে একতাবদ্ধ হোক।
গাজা যুদ্ধ জয়ের দাবিদার ইসমাইল হানিয়ে কূটনৈতিক এবং যুদ্ধজয়ের ফসল অন্যের সঙ্গে ভাগ করার উদারতা না-ও দেখাতে পারেন। তিনি ফাতাহর সঙ্গে যৌথভাবে কর্তৃত্ব চালাতে মিশেলের চিন্তার সঙ্গে একমত নন। তিনি চান মিশেলকে স্থানচ্যুত করতে। গাজা যুদ্ধ হানিয়েকে ফিলিস্তিনি রাজনীতির পাদপ্রদীপে নিয়ে এসেছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসি তাকে আলিঙ্গন করে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সাহায্য করেছেন। ইত্যবসরে ফাতাহ নেতা আব্বাস, যিনি বছরের পর বছর গাজা পরিদর্শন করেননি, তিনি এখন অনুভব করছেন, নেতৃত্ব বজায় রাখতে হলে তাকে গাজায়ও প্রভাব বিস্তার করতে হবে। হামাস আর ফাতাহ বিরোধের বাইরে আরও একটি বিরোধ আছে। হামাসের সঙ্গে ইসলামিক জিহাদের যারা গাজা যুদ্ধে অমর সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। চালিয়েছে রকেট আক্রমণ।
এত কিছুর পরও আশার কথা এই যে, গাজা যুদ্ধ এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্তির পর ফিলিস্তিনি নেতারা গুরুত্বের সঙ্গে একতাবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। জিবরিল রাজুব, ফাতাহর এক সিনিয়র নেতা রামাল্লার এক জনসমাবেশে বলেছেন, তারা হামাসের সঙ্গে সব ধরনের বিভেদ মুছে ফেলবেন। সম্প্র্রতি নির্বাচিত এক ফাতাহ মেয়র বলেছেন, তারা পশ্চিম তীরের উত্তরে তুকরামে মিছিলকারীদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ইসরায়েলি সৈন্যদের প্রতিহত করেছেন।
এটাই প্রমাণ করে, আব্বাস অব্যাহতভাবে পরাশক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে স্বাধীনতার প্রত্যাশী হলেও, ফাতাহ্র অভ্যন্তরের অনেকেই তা মানতে চাচ্ছেন না। ফলে গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনের উভয় অংশের সাধারণ মানুষ ইসরায়েলি শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এ যুদ্ধ পূর্ব জেরুজালেমেও হয়েছে। ইসরায়েলি সমর বিশারদরা বলেছেন, ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনি উত্থান (ইন্তিফাদা) শেষ হওয়ার পরবর্তী ছয় বছর কোনো লক্ষণীয় প্রতিরোধ না হলেও গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনা চৌকির ওপর প্রচুর মলোটভ ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা আক্রমণ করেছে পশ্চিম তীরের বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে নিহত হয়েছে দু'জন। ইসরায়েলের মানবতাবাদী কর্মী বিটি সালেমের নিরূপণ অনুযায়ী এ যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যরা হত্যা করেছে ১৪০ জন ফিলিস্তিনিকে, যাদের অধিকাংশই নিরীহ মানুষ।
দীর্ঘ চার বছর ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি আলোচনা বন্ধ থাকার পর সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ায় আব্বাস শান্তি আলোচনা শুরুর প্রত্যাশী।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা উত্থানের আগে দম্ভভরে বলতেন, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অবদমন করে শান্তি স্থাপন করাই একমাত্র পথ। তার এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কার্যকারিতা তিনি প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন নির্বাচন পর্যন্ত। তার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। গাজার উত্থান তার দম্ভকে তছনছ করে দিয়েছে। তিনি আবার বলেছেন, আব্বাস যদি ফিলিস্তিনের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দাবির জন্য কাজ করেন, তিনি তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এমনকি এ ব্যবস্থায় আব্বাসের পতনও হতে পারে। আব্বাস নেতানিয়াহুর ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জে তার দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। আদায় করেছেন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা।


গওসল আযম :সাবেক মহাসচিব
আইবিবি ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.