পদ্মা সেতু হবেই ৬ মাসের মধ্যে বিকল্প নক্সা করুন- সেনাবাহিনী, বুয়েট ও সড়ক বিভাগকে বললেন প্রধানমন্ত্রী

 তত্ত্বাবধায়ক নয়, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য দলের সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বব্যাংক দ্রুত সিদ্ধান্ত না জানালে নিজস্ব উদ্যোগেই বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নির্মাণের দৃঢ় ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর বিকল্প নকশা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগকে বলা হয়েছে।
বুধবার রাতে জাতীয় সংসদের নবম তলায় সরকারী দলের সভাকক্ষে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশ দিয়েছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, বৈঠকে দলের সংসদ সদস্যদের সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকল এমপির আমলনামা আমার কাছে রয়েছে। কে কী করছেন সব রিপোর্ট আমার কাছে রয়েছে। এসব আমলানামা, নিজস্ব জরিপ এবং তৃণমূল নেতাদের ভোটের ভিত্তিতেই আগামীতে মনোনয়ন দেয়া হবে। যেসব এমপির সঙ্গে এলাকার সংগঠনের নেতাকর্মীদের যোগাযোগ নেই, তাঁরা আগামীতে মনোনয়ন পাবেন না।
প্রায় সোয়া দু’ঘণ্টার এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচন কেমন এবং কোন পদ্ধতিতে হবে তা দলের সংসদ সদস্যদের কাছে পরিষ্কার করেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রারম্ভিক ও সমাপনী বক্তব্যে আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২৯ জানুয়ারি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই যে কোন দিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পৃথিবীর সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, আমাদের দেশেও একইভাবে আগামী নির্বাচন হবে। আমরা কোন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করব না। সম্পূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেব।
বৈঠক শেষে একাধিক সংসদ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন প্রসঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদ্য সমাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাজ্যেও প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেদেশে নির্বাচন হয়েছে। মার্কিন নির্বাচনে বারাক ওবামা জিতলেও যুক্তরাজ্যে টনি ব্লেয়ার হেরে গেছেন। আমাদের দেশেও জনগণ যাকে ভোট দেবে সেই ক্ষমতায় আসবে। জনগণের যে কোন রায় আমরা মেনে নেব। কিন্তু জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। নির্বাচনে কেউ কোন অনিয়ম বা কারচুপির চেষ্টা করলে সে আমার দলের হলেও তা সহ্য করা হবে না। আমার দলের কেউ করলেও তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার এবং ওই আসনের নির্বাচন স্থগিতের আবেদন করব নির্বাচন কমিশনে। তবে কোন ষড়যন্ত্রের কাছেই কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে নস্যাৎ হতে দেব না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদীয় দলের বৈঠকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ছাড়াও বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন আতিউর রহমান আতিক, মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আবু জাহির, এ্যাডভোকেট তারানা হালিম ও অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করার ঘোষণা দেন এবং আগামীতে ক্ষমতায় এলে ঢাকার দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলে ‘ওপেরা হাউস’ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের আগে উপজেলা নির্বাচনের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন তিনি।
সূত্র জানায়, বৈঠকে দলের সিনিয়র নেতারা নির্বাচনের শেষ বছরে সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলায় দলের সাংগঠনিক শক্তিকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, গত চার বছরে বর্তমান সরকার সারাদেশেই ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু শুধু উন্নয়ন দিয়েই আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী সাংগঠনিক শক্তি। তাই নির্বাচনী বছরে নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি সারাদেশেই দলকে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্য সংসদ সদস্যরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। তাঁদের অধিকাংশরই জোর দাবি ছিল স্ব স্ব এলাকায় স্কুল-কলেজের এমপিওভুক্তি।
জানা গেছে, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বলেন, দেশের জনগণকে আমি যা কথা দেই, তা পূরণ করি। পদ্মা সেতুও আমরা নির্মাণ করব। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে কোন দুর্নীতির কথা বলতে পারেনি, বলেছে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বব্যাংকের জন্য অপেক্ষা করছি। দ্রুতই এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত না এলে আমরা নিজেরাই এ সেতু নির্মাণ করব। ইতোমধ্যে বুয়েট, সেনাবাহিনী ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের সঙ্গে কথা বলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে বিকল্প নকশা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বলেন, নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণে আমরা পূর্বের নকশা অনুযায়ী অতো সুন্দর হয়ত করতে পারব না, তবে পদ্মা সেতু হবেই। ভারতের মঞ্জুরীকৃত ২শ’ কোটি ডলার আমরা এখাতে ব্যবহার করতে পারি। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, চীনসহ কয়েকটি দেশের আরও প্রস্তাব রয়েছে। আমরা সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে দ্রুতই পদ্মা সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ নেব।
সূত্র জানায়, এ বিষয়ে বৈঠকে পদ্মা সেতু নির্মাণ ইস্যুতে ‘হাসান-হোসেনের’ বিষয়টি এমপিরা তুললে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজনকে ছাড়তে আর আরেকজনকে ধরার প্রস্তাব দেয়া হয়। আবুল হাসান চৌধুরীর নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, একজন মন্ত্রীর কাছে কাজ পাওয়ার জন্য গেলেন। অথচ তিনি দোষী না হয়ে যার কাছে গেল অর্থাৎ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দোষী হলো। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে অনিয়মের জন্য যদি ধরতেই হয় তবে একজন নয়, হাসান-হোসেন দু’জনই গ্রেফতার হবেন।
বৈঠকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে নিজ নিজ এলাকায় জনমত গঠন এবং দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় কর্মসূচী সফল করার জন্য দলের সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, সংসদে দেয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণে বর্তমান সরকার গত চার বছরে যত উন্নয়ন করেছে তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই ভাষণটি প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে ভালভাবে পড়ে সংসদে ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় কথা বলতে হবে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-গুলো দেশের জনগণের ঘরে ঘরে তুলে ধরতে হবে।
পুলিশের ওপর হামলা প্রসঙ্গে বৈঠকে তোফায়েল আহমদ বলেন, হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে হবে। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারী দলের হয়ে কাজ করে দেবে না। সাংগঠনিকভাবেই বিরোধী দলের জবাব দিতে হবে।
সংসদীয় দলের বৈঠক শেষে সংসদের মিডিয়া সেন্টারে চীফ হুইপ আব্দুস শহীদ সাংবাদিকদের বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য অতীতে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে। আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যা যা করার দরকার সরকার সবই করেছে। বিরোধী দল সংসদে এলে প্রয়োজনে ১৬তম অধিবেশনের মেয়াদ বাড়তে পারে বলেও জানান চীফ হুইপ।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালে সংবিধান সংশোধন করা হবে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদ বলেন, দেশে এমন কোন সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়নি যাতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।ৃ

No comments

Powered by Blogger.