কতজন এলোগেলো... কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়- আড্ডায় মুখর কলকাতার এ্যালবার্ট হল

সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবুু আছে/সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই/একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি/শুধু সেই সেদিনের মালী নেই...। হ্যাঁ, আসলে ব্যাপারটা তাই।
কফি হাউস অনেকেই ছেড়েছেন। স্বাভাবিক নিয়মেই ছাড়তে হয়েছে। তবে আশ্চর্য, একটি টেবিলও খালি হয়নি! খালি হয় না। বরং এখনও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ঢল নামে কফি হাউসে। কফি চলে। চলে তুমুল আড্ডা। আর সব রেস্তরাঁর সকাল-বিকেল আছে। পিক-অফপিক হয়। কিন্তু সে ফুরসত নেই কফি হাউসের। বরং ভারি পাল্লার বিশাল কপাট খোলা মাত্রই হাউসফুল! এ অবস্থা চলমান থাকে বন্ধের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। একেবারে সাধারণ মানুষ যান নাÑ তা নয়। তবে সরগরম করে রাখে আশপাশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। আর কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদদের আড্ডার তো কোন তুলনা হয় না। এখানে কফি খাননি এমন বিখ্যাত মানুষ কলকাতায় নেই বললেই চলে। ক্লিনটনের মতো বিশ্বনেতারাও ঢুঁ মেরেছেন। এসব কারণে আলাদা খ্যাতি কফি হাউসের। টাকা দিয়ে কফি খাওয়া আর আড্ডা জমানোর পাশাপাশি হাউসটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক হয় লেখক-কবিদের। সে সম্পর্কের কথা গল্পে, কবিতায় বার বার এসেছে। আসছে। আর মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গান ছাড়া তো কফি হাউসের আলাপই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বন্ধু আড্ডা হৈ হুল্লোড়প্রিয় বাঙালী সুযোগ পেলেই কণ্ঠ ছাড়েনÑ কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই...। এ ‘নেই’- এর মানে যতটা নেই, তারও বেশি থাকার আকুতি। আর এ আকুতিই হয়ত টিকিয়ে রেখেছে কলেজ স্ট্রীটের বিখ্যাত কফি হাউসটিকে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া কলকাতায় অসংখ্য ফাস্টফুড, আধুনিক রেস্তরাঁ হয়েছে। এর পরও ১৬০ বছরের পুরনো বিল্ডিং এ্যালবার্ট হলে কফি খেতে যান বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এর আলাদা মজা। রোমাঞ্চকর অনুভূতি। শুধু কী তাই? বাঙালীর ঐতিহ্যের অংশ এখন কফি হাউস।
জানা যায়, সেই ১৮৭৬ সালে নির্মিত হয় ভবনটি। নির্মাণ করেছিলেন অভিরাম মল্লিক। এটি ছিল তাঁর বসতবাড়ি। পরবর্তীতে আসে রাজ্য সরকারের মালিকানায়। ১৯৪১-৪২ সালের দিকে ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের উদ্যোগে সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউতে একটি কফি হাউস খোলা হয়। এর কিছু পরে চালু হয় এ্যালবার্ট হলের কফি হাউসটি। ১৯৫৮ সালের ১৫ অক্টোবর এটি ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা থেকে বেরিয়ে আসে। তখন থেকেই মূলত যাত্রা শুরু করে আজকের কফি হাউস। এর পরিচালনার দায়িত্ব পায় শ্রমিকদের গড়া কোঅপারেটিভ সোসাইটি। অর্থাৎ যাঁরা শ্রমিক তাঁরাই হন মালিক। এমন শ্রমিক ও মালিকের সংখ্যা ছিল এক শ’র মতো। বর্তমানে তাঁদের কেউ বেঁচে নেই। তবে পরবর্তী বংশধররা আছেন। তাঁরাই চালাচ্ছেন কফি হাউস। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কফি হাউসের গায়ে গা লেগে আছে আরও কিছু পুরনো বিল্ডিংয়ের। তাই খুব আলাদা করে এটি চোখে পড়ে না। কাছে গেলে সাইনবোর্ডটি পরিষ্কার হয়। তবে ভেতরে ঢোকার পর সত্যি মন ভাল হয়ে যায়। কী যে উৎসব, কী যে প্রাণের খেলা! নিচ তলায় যেমন, তেমনি উপরের অংশে। কফি হাউস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর মোট আয়তন ৯ হাজার ৫শ’ ৪৫ বর্গফুট। টেবিল সংখ্যা এখন ২শ’র মতো। চেয়ার আছে সাড়ে ৫শ’। খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। নিচ তলাটিকে বলা চলে মূল অংশ। এখানে ঢুকতেই চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রতিকৃতি। মেঝেতে পাতা চেয়ার-টেবিল। যারা একটু দল বেঁধে চলেন, তাঁরাই মূলত বসেন এখানে। নানা বিষয়ে গল্প জমান। কখনও এই মুখ, কখনও ওই মুখ সরব হয়। একসঙ্গে সবাই বলছেনÑ এমন মজার দৃশ্যও চোখে পড়ে! শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব হয় এখানে। তেমন একটি আড্ডায় পাওয়া যায় টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের দৈনিক এই সময়-এর সাংবাদিক গৌতম বসুমল্লিককে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েক তরুণ। কী নিয়ে চলছে আজ? জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, তেমন কিছু নিয়ে নয়। অবশ্য কয়েক মিনিটের মধ্যে জানা যায়, সম্প্রতি দিল্লীতে তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় দারুণ ক্ষুব্ধ তাঁরা। সে কথাই হচ্ছিল। পাশের টেবিলে আবার অন্য আলোচনা। দীপঙ্কর নামের এক তরুণ জানালেন, কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন মেলা চলছে। সেটির ভাল-মন্দগুলো খোঁজার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। এভাবে নানা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল নিচতলায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তো এই অভিযোগও করেছেন, এখন কফি হাউস হয়ে উঠেছে মাওবাদীদের মিটিংয়ের জায়গা! জায়গাটিকে নিজেদের পরিকল্পনা তৈরির জন্য বেছে নিচ্ছে মাওবাদীরা! বুঝুন তবে!
নিচতলার কোন ছাদ নেই। এখান থেকে মাথা তুলে উপরে তাকালে দেখা যায় দুই তলার ছাদ। সঙ্গত কারণেই দুই তলাটি ঠিক দুই তলা নয়। এর মাঝখানটা শূন্য। দেয়ালের চারপাশ ঘেঁষে সরু ব্যালকনি। ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল পাতা। খ্যাতিমান শিল্পীদের আঁকা ছবি টানানো। পরিবেশটাও খুব নিরিবিলি। সব মিলিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদের খুব পছন্দ। শুধু ভালবাসাবাসি নয়, মান অভিমানও চলে এখানে। উদাহরণ? রুহিত-পৌলমী। শিয়ালদহর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের এ দুই শিক্ষার্থী একে অন্যকে ভীষণ ভালবাসেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনেক আগে থেকেই তাঁরা কফি হাউসে আসেন। তবে এক সময় বন্ধুদের সঙ্গে আসতেন। আর এখন দু’জন মিলে আসেন। তাঁদের মতে, যে কোন জায়গায় বসা যায় বটে। তবে কফি হাউস তো কফি হাউসই! জানা যায়, এখানে সবচেয়ে বেশি থাকেন আশপাশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এঁরা কফিহাউসে বসেন সকাল ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। এর পর প্রবেশ করেন ‘আপিসে’র লোকরা। সন্ধ্যায় আড্ডা জমান লেখক-কবিরা। বিশেষ করে শনিবার বিকেলে তাঁদের পাওয়া যায় কফি হাউসে। এভাবে নানা পেশার মানুষ মুখরিত করে রাখে কফি হাউস।
সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক বিজয় কুমার নায়েক জানান, শুরুতে এই কফি হাউসের ভাড়া ছিল ১ হাজার ৪৫ টাকা। আর কফির দাম ১৯ পয়সা করে। বর্তমানে প্রতি মগ কফি বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা করে। প্রতিদিন বিক্রি হয় ২ হাজার মগের মতো। গত বছরের মে মাসে সর্বশেষ কফির দাম বাড়ানো হয়। তবে প্রক্রিয়াটি সহজ নয়। এ প্রসঙ্গে নায়েক বলেন, চক দিয়ে লিখে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই এখানে। এ জন্য রাজ্য সরকার, কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন ও সোসাইটির প্রতিনিধি মিলে বৈঠকে বসতে হয়। সবাই একমত হলে দাম বাড়ে! অবশ্য কফি হাউসে কফিই শেষ কথা নয়। আরও অনেক কিছু মেলে। পাওয়া যায় পাঁকুড়া, কাজু বাদাম, আলু চিপস, আইসক্রিম, স্যান্ডউইচ, দোসা। ফ্রায়েড রাইস, ফ্রায়েড চিকেন, চাইনিজ আইটেমও হয় কফি হাউসে। তবে শুধু খাওয়া নয়, কফি হাউসের কর্মীদের ব্যবহারও মুগ্ধ করে রাখে অতিথিদের। যেই আসুক যখন আসুক মন জয় করার চেষ্টা করেন তাঁরা। যিনি মালিক সেই তিনি কফি ঢেলে দেন। মেঝে ঝাড়ু দেন। এ আতিথেয়তা আরও বহুকাল অব্যাহত থাকবেÑ সকলের তাই প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.