রাস্তার ঢালে গুলিবিদ্ধ চোখ বাঁধা তিন লাশ

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলার পৃথক দুটি স্থানে গতকাল বৃহস্পতিবার তিনটি লাশ পাওয়া গেছে। তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনজনের লাশই পড়ে ছিল সড়কের পাশে। সবার চোখ ছিল নতুন গামছা দিয়ে বাঁধা।
নিহত ব্যক্তিরা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ ছিলেন বলে তাঁদের স্বজনেরা জানিয়েছেন।
এর আগেও এই এলাকা থেকে একইভাবে গুলিবিদ্ধ এবং হাত ও মুখ গামছায় বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা কোনো বাহিনীর হাতে তাঁরা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন বলে তাঁদের স্বজনেরা অভিযোগ করেছিলেন।
মুন্সিগঞ্জে গতকাল উদ্ধার হওয়া নিহত তিন ব্যক্তিরই পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন: রাজধানীর পূর্ব জুরাইনের মো. ইব্রাহীম (২০), ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তানাক্কা মার্কেটের তৈরি পোশাক (মিনি গার্মেন্টস) ব্যবসায়ী কুদ্দুস বেপারী (৪০) ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা এলাকার রাঢ়ী মাসুদ (৩০)। লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ইব্রাহীম জুরাইনের স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ইসমাইল হোসেন মোল্লা হত্যা মামলার আসামি। গত ৩১ ডিসেম্বর নিজ বাসার সামনে খুন হন ইসমাইল। বাকি দুজনের মধ্যে রাঢ়ী মাসুদের বাবার নাম মির্জাহান খান আর কুদ্দুসের বাবা মৃত আবদুল খালেক। কুদ্দুসের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে। এই দুজনের সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ জানায়, তিনটি লাশেরই বুকে, গলায় ও মাথায় গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এঁদের চোখ ছিল নতুন গামছা দিয়ে বাঁধা। পুলিশের ধারণা, একই দুর্বৃত্তদের হাতে তিনজন খুন হতে পারেন। অন্য কোথাও হত্যার পর এঁদের এখানে পৃথক দুই জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছে। নিহত মাসুদের পরনে ছিল আকাশি রঙের ট্রাউজার ও ফুলহাতা সাদা গেঞ্জি। অপর দুজন কালো প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা ছিলেন।
পুলিশ জানায়, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক থেকে নিমতলী-সিরাজদিখান সড়ক ধরে চার কিলোমিটার এগোলেই রশুনিয়া ইউনিয়নের ইমামগঞ্জ। এখানেই গতকাল সকাল আটটার দিকে পুলিশ দুটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে। পরে মো. ইব্রাহীম ও কুদ্দুস বেপারী নামে তাঁদের শনাক্ত করেন স্বজনেরা। সড়কের ঢালে ১০০ গজের মতো দূরত্বে লাশ দুটি পড়ে ছিল। আশপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আলুখেত। ঘটনাস্থলের এক বর্গকিলোমিটারের মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি নেই। পুলিশের ধারণা, গাড়ি থেকে লাশগুলো ফেলে চলে গেছে দুর্বৃত্তরা।
এর কয়েক ঘণ্টা পর দুপুর ১২টার দিকে শ্রীনগর উপজেলার হাঁসাঢ়া-বাড়ৈখালী সড়কের পাশের শ্রীধরপুর থেকে আরেকটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সকালে লাশ দেখে এলাকাবাসী পুলিশকে খবর দিয়েছিল। পরে স্বজনেরা এসে তাঁকে রাঢ়ী মাসুদ নামে শনাক্ত করেন।
ঢাকা-মাওয়া সড়ক থেকে হাঁসাঢ়া-বাড়ৈখালী সড়ক ধরে পাঁচ কিলোমিটার এগোলেই ঘটনাস্থল। সড়কটি চলে গেছে আড়িয়ল বিলের ভেতর দিয়ে। এর আশপাশে কৃষিজমি, মাছের ঘাট ছাড়া কোনো বাড়িঘর নেই।
নিহত ইব্রাহীম: ইব্রাহীমের বাবা খোরশেদ আলম জানান, তাঁর ছেলে ১৬ জানুয়ারি কাতারে যাওয়ার জন্য বনানীতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে যান। পরীক্ষা শেষে বেলা তিনটার দিকে বাড়িতে ফোন করেছিলেন। ওটাই ছিল শেষ যোগাযোগ। এর পর থেকে তিনি নিখোঁজ। তাঁর ফোনও বন্ধ ছিল। এর পরদিন তাঁরা কদমতলী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর বাবা বলেন, ‘হ্যায় বিদেশ যাওয়ার লাইগা দৌড়াদৌড়ি করতাছিল। হ্যায় খুন করব কির লাইগা।’
তবে রাজধানীর কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা ইসমাইল মোল্লা হত্যার ঘটনায় সন্দিগ্ধ ছিলেন ইব্রাহীম। ওই হত্যা মামলায় জুরাইনের বউবাজারের সজীব ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে ঘটনার সঙ্গে ইব্রাহীমের জড়িত থাকার কথা বলেছেন। তাঁর দাবি, ইব্রাহীম ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত ডাকাত শহীদের প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী কালা মীর গ্রুপের সদস্য ছিলেন।
কুদ্দুস ও মাসুদ: স্বজনেরা জানান, ১০ জানুয়ারি নিখোঁজ হয়েছিলেন কুদ্দুস ও মাসুদ। কুদ্দুস বেপারীর ভাতিজা আবু রায়হান জানান, মিনি গার্মেন্টসের ব্যবসা ছিল তাঁর চাচার। ১০ জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না, তাঁর বিশেষ কোনো শত্রুও ছিল না।
হাসপাতালে লাশ শনাক্ত করতে এসেছিলেন মাসুদের মা ডালিয়া বেগম ও ভাবি নূরজাহান বেগম। মাসুদ নিখোঁজের বিষয়ে করা জিডির কাগজটি হাতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তাঁর মা। বিলাপ করে বলছিলেন, মাসুদ সোনালি রঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা ও কালো স্যান্ডেল পরে বের হয়েছিলেন। কিন্তু এখন গায়ে আকাশি ট্রাউজার আর সাদা গেঞ্জি। লাশ ধরে বিলাপ করে মা বলছিলেন, ‘মনে হয়, কাউলকাই মারছে। বুকে তাজা রক্ত এহনো জমাট বাইধা রইছে।’
মাসুদের স্বজনেরা জানান, তিনি আগে কেরানীগঞ্জের সোয়ারীঘাটে খেয়াঘাটের টোল আদায় করতেন। কয়েক মাস ধরে বেকার ছিলেন।
তবে কুদ্দুস বেপারী ও রাঢ়ী মাসুদের নিখোঁজের বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন।
সিরাজদিখান থানার ওসি মাহবুবুর রহমান বলেন, সিরাজদিখান থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি লাশেরই একই জায়গায় একইভাবে গুলি করা হয়েছে। শ্রীনগর থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, শ্রীনগরের শ্রীধরপুর থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের সঙ্গে সিরাজদিখানে উদ্ধার হওয়া দুই লাশের হত্যার ধরনে মিল পাওয়া গেছে। একইভাবে গুলি করে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। এই লাশের চোখ তিনটি নতুন গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল।
মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) এহসানুল করিম জানান, দুজনের ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় একজনের করা হয়নি। কাল (আজ) করা হবে। তিনি জানান, তিনজনের হত্যার ধরন একই রকমের। নিহত ব্যক্তিদের শরীরের ছিদ্রগুলো যে গুলির চিহ্ন, তা নিশ্চিত বলা যায়।

No comments

Powered by Blogger.