মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- মুহম্মদ জাফর ইকবাল

এর মাঝে ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি বাঙালীদের ভালবাসা এবং মমতার শহীদ দিবস উদযাপিত হলো অন্য এক ধরনের উন্মাদনায়। শহীদ মিনারে সেদিন মানুষের ঢল নেমেছে, তাদের বুকের ভেতর এর মাঝেই জন্ম নিতে শুরম্ন করেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
২১ ফেব্রম্নয়ারিতে বাঙালীদের সেই উন্মাদনা দেখে পাকিসত্মান সেনাশাসকদের মনের ভেতরে যেটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল সেটিও দূর হয়ে গেল। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিল সংখ্যালঘু দলে, তার ৰমতার অংশ পাবার কথা নয়, কিন্তু সে ৰমতার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ঠিক দুই দিন আগে ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল। পূর্ব পাকিসত্মানের বাঙালীদের বুকের ভেতর ৰোভের যে বারম্নদ জমা হয়েছিল, সেখানে যেন অগি্নস্ফুলিঙ্গ স্পর্শ করল। সারাদেশে বিৰোভের যে বিস্ফোরণ ঘটল তার কোন তুলনা নেই।

উত্তাল মার্চ
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে গেছে, এ ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হয়েছে, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিসত্মানের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছে। মুহূর্তের মাঝে জনতা বিৰুব্ধ ওয়ে ওঠে, ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে একটি যুদ্ধৰেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। লাখ লাখ মানুষ পথে নেমে আসে, পুরো ঢাকা শহর দেখতে দেখতে একটি মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। মানুষের মুখে তখন উচ্চারিত হতে থাকে স্বাধীনতার সেস্নাগান : 'জয় বাংলা', 'বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।'
বঙ্গবন্ধু ঢাকা এবং সারাদেশে মিলিয়ে ৫ দিনের জন্য হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু পাকিসত্মান সরকারকে কোনভাবে সাহায্য না করার কথা বলেছিলেন এবং তাঁর মুখের একটি কথায় সারা পূর্ব পাকিসত্মান অচল হয়ে গেল। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য কারফিউ দেয়া হলো_ ছাত্র জনতা সেই কারফিউ ভেঙ্গে পথে নেমে এলো। চারদিকে মিছিল, সেস্নাগান আর বিৰোভ, সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে তারপরেও কেউ থেমে রইল না, দলে দলে সবাই পথে নেমে এলো।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' গানটি নির্বাচন করা হলো।
পাঁচ দিন হরতালের পর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বর্তমান সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানে ভাষণ দিতে এলেন। ততদিনে পুরো পূর্ব পাকিসত্মান চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়। লাখ লাখ মানুষ তাঁর ভাষণ শুনতে এসেছে, সোহরাওয়াদর্ী উদ্যান আৰরিক অর্থে একটি জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মৃক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম ভাষণ খুব বেশি দেয়া হয়নি। এই ভাষণটি সেদিন দেশের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অকাতরে প্রাণ দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি জুগিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে একদিকে যখন সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে_অন্যদিকে প্রতিদিন দেশের আনাচে-কানাচে পাকিসত্মান মিলিটারির গুলিতে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। পাকিসত্মান মিলিটারির গতিবিধি থামানোর জন্য ছাত্র-শমিক-জনতা পথে পথে ব্যারিকেড গড়ে তুলছে। সারাদেশে ঘরে ঘরে কালো পতাকার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাক উড়ছে।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.