বন্ধু- আশাবরী রায়

মহাকাশের সবচেয়ে বড় স্পেসফিল্ড 'সিকার'। সবসময় শানত্ম থাকলেও গত ক'মাস ধরে এটা ভয়ানক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পৃথিবী আর ভেনাসের প্রতিনিধিরা এই স্পেসফিল্ডকেই যুদ্ধের জন্য নির্বাচিত করেছেন।
আর গত ক'মাস ধরে পৃথিবী আর ভেনাসের যুদ্ধের পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে এই শানত্ম স্পেসফিল্ডটাও উত্তপ্ত হয়ে চলেছে। স্পেসফিল্ডের পাশে রাখা সৈনিকদের মহাকাশযানগুলোতেও বিরাজ করেছে অস্থিরতা। কোনটা থেকে ভেসে আসছে শূ্যটিং প্র্যাকটিসের আওয়াজ, আবার কোনটা থেকে ভেসে আসছে আহতদের অমানুষিক আর্তনাদ। শুধুমাত্র একটা স্পেসশিপ থেকে কোন আওয়াজ ভেসে আসছে না। স্পেসশিপটা দুই অনত্মরঙ্গ সৈনিক বন্ধু লুইস আর ফিরার নামে বুক করা হয়েছে। বর্তমানে তারা দু'জন স্পেসশিপের ভেতরই রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে আরও আছেন যুদ্ধাহতদের জন্য নিয়োজিত ডাক্তার ওয়াটসন। ফিরাকে চিকিৎসার জন্য স্পেসশিপে আনা হয়েছে। কিছুৰণ আগে ফেটে যাওয়া বোমা 'সোল'-এর আঘাতে ফিরা ভয়ানকভাবে আহত হয়েছে। সে একটা স্পেসশিপে করে 'সোল' নামক বোমাটাকে নিয়ে যাচ্ছিল ৩২ নম্বর সেক্টরে। স্পেসশিপের কন্ট্রোল প্যানেলে গ-গোল হওয়ার কারণে সে 'সিকার'-এর বায়ুম-ল থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। আর তখন বায়ুম-লের বাইরে থাকা লেকটোফোর্ম গ্যাসের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বোমাটা ভয়ঙ্করভাবে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের কিছুৰণ পর ফিরাকে স্পেসফিল্ডের পাশের সিভিলকেসের ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই সে স্পেসশিপে শুয়ে আছে। আর ঠিক তখন থেকেই ড. ওয়াটসন তাকে পরীৰা করছেন। কিন্তু এখনও পর্যনত্ম তিনি মুখ খোলেননি। আরও কিছুৰণ ফিরার দিকে তাকিয়ে থেকে, তিনি হঠাৎ কথা বললেন,
_লুইস, আমি খুবই দুঃখিত। ফিরাকে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে, যা অত্যনত্ম ভয়ানক। এতে আক্রানত্ম রোগীকে উইথিস বলে। উইথি নামক একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে এ রোগ হয়। সেই বোমাটার বিস্ফোরণ হয়েছে, তার মধ্যে উইথি ব্যাকটেরিয়া ছিল। আর সেটাই ফিরার শরীরে ঢুকে পড়েছে। এই ব্যাকটেরিয়ার সবচেয়ে বাজে দিক হলো, এটা একবার কারও শরীরে ঢুকে গেলে, আর বের হয় না। তাছাড়া এটা খুব তাড়াতাড়ি বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। তুমি, আমি, আমরা সবাই এখানে ডেটারলের যুদ্ধপোশাক পরে আছি দেখে, আমাদের শরীরে উইথি প্রবেশ করতে পারছে না। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষেরা কিন্তু ডেটারলের জামা কাপড় পরে থাকবে না। তাই আমার মনে হয় ফিরাকে পৃথিবীতে নেয়া ঠিক হবে না। আর তাছাড়া উইথিগুলো ওর ভেতরে ঢুকে ওকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। ওর সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। অজ্ঞান থাকার কারণে সে সেকথা কাউকে বলতেও পারছে না। দেখ লুইস, একজন সৈনিক হওয়ার দরম্নন তোমার কাছে যে কোন অপরাধীকে মেরে ফেলার লাইসেন্স আছে আর ফিরার শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে অন্যের ৰতি করলে সেও একজন অপরাধী হয়ে উঠবে। তাই তোমার উচিত একজন অপরাধীকে জন্মানোর আগেই শেষ করে দেয়া। সে তোমার যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন। নিষ্ঠুরের মতো এই কথাগুলো বলার পর ওয়াটসন কিছুৰণ বসে থেকে লুইসকে সানত্ম্বত্মনা দিল। একটু পরই সে স্পেসশিপ থেকে বের হয়ে গেল। আর লুইস স্পেসশিপের ভেতরে বসে বসে ওয়াটসনের এক একটা কথার কাঁটা তার শরীর থেকে বের করতে লাগল।

প্রায় তিন মাস হলো লুইস ফিরাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরেছে। ডেটারলের জামা-কাপড় পরে লুইস বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। এমস সময় হঠাৎ একটা খবরে তার চোখ আটকে গেল। খবরে দু'জন অসুস্থ মানুষকে দেখাচ্ছিল, যাদের উইথি ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে। তাদের সারা শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনেরা কান্নাকাটি করছে। তারা কেউ জানেও না যে কিভাবে এই রোগ তাদের আক্রমণ করল। টিভিতে মানুষগুলোকে দেখে লুইস চিনতে পারল। তাদের পাশের কোয়ার্টারের ম্যাথন পরিবারের দুই ছেলে। তারা কেন এ রোগে আক্রানত্ম হয়েছে, তাও লুইস বুঝতে পারল। সে টিভির দিকে কিচুৰণ তাকিয়ে থেকে সেটা অফ করে দিল। অনেকৰণ ধরে বসে বসে কি যেন চিনত্মা করল। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়িটার দিকে কিছুৰণ তাকিয়ে রইল। তারপর টেবিলটার কাছে গিয়ে ঝুড়িটা থেকে সে ফল কাটার ছুরিটা বের করল। সেটা নিয়ে এগিয়ে গেল বিছানায় শুয়ে থাকা ফিরার দিকে। কিছুৰণ-দাঁড়িয়ে থেকে সে তার বন্ধুকে দেখল। ফিরার নিষ্পাপ চেহারাটার দিকে তাকাতেই যেন সে ফিরে গেল তার শৈশবে। সে দেখল, ফিরা আর সে একসঙ্গে খেলছে। একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে, দুষ্টুমি করে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। খেলতে খেলতে হঠাৎ লুইস হাঁটুতে ব্যথা পেল। ফিরা ছুটে চলে গেল বন্ধুর ব্যথা সারানোর জন্য ওষুধ আনতে। এরপর লুইস আর কিছু ভাবতে পারল না। মাথা ঘুরে বসে পড়ল বিছানায়।

লুইসের বাড়ির বাইরে একটা ঝাউগাছের পেছনে অনেক পাখি-একসঙ্গে কিচিরমিচির করছে। তারা লুইসের কবরের ওপর ভিড় করেছে। পাখিগুলো লুইসের ফলকটাকে দেখছে আর চেচামেচি করছে। তিন বছর ধরে তারা ঠিক এই সময়টায় এই একটা কাজই করে থাকে। সন্ধ্যা নামছে, একটা পাখি হঠাৎ উড়ে গেল। আর তার দেখাদেখি অন্য সব পাখিও উড়তে শুরম্ন করল। আর ঠিক তখনই পেছনে ফেলে যাওয়া লুইসের কবরের ফলকে, মৃতু্যর কারণ হিসেবে লেখা 'অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতে খুন' কথাটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল। তার বদলে দেখা গেল 'বন্ধুকে হত্যার পর আত্মহত্যা' লেখাটা।

No comments

Powered by Blogger.