গলাচিপায় সংখ্যালঘুর বাড়িতে আগুন, কিশোরী অপহরণ- প্রভাবশালীর দাপট ॥ ৭ পরিবারে আতঙ্ক

 পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ছোটগাবুয়া গ্রামের হতদরিদ্র সংখ্যালঘু মনোরঞ্জন বাঘমারের বাড়িতে এখন শ্মশানের নিরবতা। ঘরের ভিটায় পুড়ে যাওয়া কাঠ আর হোগলপাতার স্তূপ।
চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো পুরনো টিন। উপুড় হয়ে পড়ে আছে রান্নার চুলা। বাসনকোসন পড়ে আছে এখানে সেখানে। কারও পেটে পড়ছে না ভাত। নেই রাতের ঘুম। বরং গোটা বাড়ির নারী-পুরুষ এবং শিশুদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে এক অজানা আতঙ্কে। এই বুঝি আবার এলো ওরা। গত ৬ দিন ধরে বাঘমার বাড়ির ৭টি পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের এ ভাবেই কাটছে সময়।
জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে একই গাঁয়ের প্রভাবশালী জোতদার আনোয়ার হোসেন ও তার দোসররা বাঘমার বাড়িতে রাতের আঁধারে শুধু হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। চালিয়েছে লুটপাট। জীর্ণ বসতঘর পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। অপহরণ করে নিয়ে গেছে মনোরঞ্জন বাঘমারের কিশোরী মেয়ে রিতুমণি ওরফে মরিকে। সে সঙ্গে দিয়ে গেছে হুমকিÑএ নিয়ে বাড়াবাড়ি হলে বাড়ির কাউকে আস্ত রাখা হবে না। সবাইকে হয় দেশ ছাড়তে হবে, নয়তো কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হবে। পুলিশ এ ঘটনায় এ যাবত একজনকে গ্রেফতার করলেও উদ্ধার হয়নি অপহৃত রিতুমণি। ঘটনার শীর্ষ হোতারাও কেউ গ্রেফতার হয়নি।
মামলার বিবরণ ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গত ২১ জানুয়ারি সোমবার গভীর রাতে একই গাঁয়ের প্রভাবশালী জোতদার আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের ছেলে মজিবর রহমান টিপুর (২৮) নেতৃত্বে ১৫/১৬ জনের একদল দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী অনিল বাঘমারের ঘরে হামলা চালায়। এ সময় ঘরের মধ্যে দিনমজুর অনিল বাঘমার (৭৫), তার ছেলের বউ কাজল রানী, কাকা মনোরঞ্জন বাঘমারের মেয়ে (চাচাত বোন) রিতুমণি ওরফে মরি (১৭) ও ছোট্ট এক শিশু ঘুমিয়েছিল। সন্ত্রাসীরা পাতার দরজা ভেঙে ঘরের মধ্যে ঢুকেই রিতুমণি ওরফে মরির মুখ চেপে ধরে। রিতুমনির গোঙানির শব্দে কাজল রানী চিৎকার করে উঠলে সন্ত্রাসীরা তাকে থাপ্পড় মারে। সন্ত্রাসীরা মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে রিতুমনিকে পাজাকোলে করে তুলে নিয়ে যায়। সঙ্গী অন্য সন্ত্রাসীরা এ সময় অস্ত্রেরমুখে কাজল রানীর কানের রিংসহ ঘরের মালামাল লুট করে। মনোরঞ্জন বাঘমার ও তাঁর স্ত্রী রীতা রানী মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘রিতুমণিকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ায় আমরা কান্নাকাটি শুরু করলে সামনের রাস্তায় দাঁড়ানো আনোয়ার হোসেন আবার একদল সন্ত্রাসী পাঠিয়ে ঘরে আগুন দেয়ার নির্দেশ দেয়। এরপরই ঘরটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় মাথা গোজার একমাত্র আশ্রয়।’
বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ মনোরঞ্জন বাঘমার অভিযোগ করেছেন, গলাচিপা শহরে আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কর্মরত আনোয়ার হোসেন হাওলাদার তাঁদের তিন একর ৩৮ শতক জমি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছেন। এ নিয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা চলছে। সর্বশেষ ৮০ শতক জমির দখল নিয়েছেন। জমি ফেরত পাওয়ার জন্য গলাচিপা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছেন। এরপর থেকে আনোয়ার হোসেন মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছেন। এর জের ধরেই বর্বরোচিত এ ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, ‘শ্যাষের মামলাডার কারণেই অরা আমাগো সর্বনাশ করছে। মাইয়াডারে তুইল্যা নিছে। আমাগো ভিডা দিয়া উৎখাত করতে ঘরে আগুন দিয়া পুইড়া দিচ্ছে।’ রীতা রানী বলেন, ‘জমিজমার লইগ্যা অরা আমাগো মাইয়াডা লইয়া গ্যাছে। আমরা আর কিছু চাই না। আমাগো মাইয়াডা ফেরত আইন্যা দ্যান।’
এ ঘটনায় অনিল বাঘমার ২৩ জানুয়ারি বুধবার গলাচিপা থানায় মজিবর রহমান টিপু, রাসেল, দেলোয়ার হোসেন, বাচ্চু হাওলাদার, জাহাঙ্গীর হাওলাদার, জৌলাস ওরফে জুলহাস হাওলাদার, ফজলুল হক হাওলাদার ও আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের নাম উল্লেখসহ আরও অজ্ঞাত ৭/৮ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। মামলা ও ঘটনার বিষয়ে গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জ এস.এম. জিয়াউল হক জানান, সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়ার পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। মামলার ২ নম্বর আসামি রাসেলকে (২৫) গ্রেফতার করা হয়েছে। অপহৃতের খোঁজ জানতে রাসেলকে পাঁচদিনের রিমান্ড চাওয়া হলেও একদিনের রিমান্ড পাওয়া গেছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। অপহৃত কিশোরীকে উদ্ধার ও বাকি আসামিকে গ্রেফতারে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঘটনার বিষয়ে মামলার ১ নম্বর আসামি ও আনোয়ার হোসেনের ছেলে মজিবর রহমান টিপু (৩৮) পলাতক অবস্থায় মোবাইল ফোনে জানান, বাঘমার বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে তাদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তাই বলে তারা মেয়ে অপহরণ কিংবা ঘরে আগুন দেয়নি। পুরো ঘটনা একটি সাজানো নাটক।
এ বিষয়ে এলাকার ইউপি মেম্বার মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনা সত্য বলে শুনেছি। মেয়েটি এখনও উদ্ধার না হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক।

No comments

Powered by Blogger.