যদ্যপি মোর গুরু... by মোফাজ্জল করিম

স্বাধীনতাপূর্বকালে সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) অফিসারদের প্রশিক্ষণের একটা বড় অংশজুড়ে ছিল জেলা প্রশাসকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকে কাজ শেখা। লাহোর একাডেমীর 'সর্বব্যাপী' ট্রেনিংয়ের পর এই প্রশিক্ষণকাল ছিল ন্যূনপক্ষে এক বছর।


ওই সময়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষানবিস অফিসারটিকে সব সময় জেলা প্রশাসকের কাছে কাছে থাকতে হতো ছায়ার মতো। আর এভাবেই প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে গুরুস্থানীয় সিনিয়রের কাছ থেকে সব কিছু শিখতে হতো হাতে-কলমে। এই শেখার ব্যাপারে সেই প্রচলিত পদবি ছিল 'প্রবেশনার'- অনেক স্বাধীনতা ছিল : যেকোনো বিষয়ে তিনি প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে পারতেন 'বস্কে', তাঁর সফরসঙ্গী হতেন সবখানে, বসের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে পারতেন প্রায় সব ধরনের সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানাদিতে। এমনকি নানা রকম আবদার-আহ্লাদও করতে পারতেন, যেমনটি পরিবারের অগ্রজের কাছে করে থাকেন অনুজ। শুধু যে দাপ্তরিক কাজকর্মের বিষয়েই প্রশিক্ষণলাভ করতেন তিনি তা নয়, লোকাচার, শিষ্টাচার, কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ, জনসংযোগ, প্রটোকল ইত্যাদি প্রায় সব বিষয়েই তাঁর 'রোল-মডেল' জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে তিনি যা শিখতেন তা-ই ছিল তাঁর পরবর্তী জীবনের মূল্যবান পাথেয়।
সাধারণভাবে সিনিয়রদের সমীহ করা, তাঁদের যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা, অগ্রজতুল্য জ্ঞান করা, সেই সঙ্গে জুনিয়রকে স্নেহ করা, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানদান করা, সদুপদেশ দেওয়া, সর্বোপরি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নেতৃত্ব প্রদান- এগুলো সিভিল সার্ভিস, সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ সব সার্ভিসের সযত্নে লালিত ও সুপ্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল ট্র্যাডিশন। এর ব্যত্যয় ঘটা মানে পুরো সার্ভিস-কাঠামো হুমকির মধ্যে পড়া। এই ট্র্যাডিশন ধরে রাখার জন্য সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ সব সদস্যকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হয়। এটা নয় যে কনিষ্ঠ সহকর্মী সব সময় জি-হুজুর-যো হুকুম করতে থাকবেন এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাঁর শিরোপরি যষ্টি ঘোরাতে থাকবেন। বরং এ ক্ষেত্রে সিনিয়রের দায়িত্ব বেশি; তাঁকে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, তাঁর আচার-আচরণে, কথাবার্তায়, চালচলনে যেন কোনো ত্রুটি ধরা না পড়ে। যদি পড়ে তবে তাঁর পক্ষে ক্ষমা চাইতে দোষ নেই ঠিকই, তবে তা হবে লজ্জাকর। অথচ জুনিয়র কোনো ভুল করে নিশ্চয়ই মাপ চাইতে পারে, কারণ ভুল করা তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়, সে ভুল করতেই পারে, সে নবীন।
(২)
লেখাটি এ পর্যন্ত পড়ে পাঠক বোধ হয় ভাবছেন- কী ব্যাপার, এই ভদ্রলোকের আজকে হলো কী? ইনি হঠাৎ করে সিএসপি-দের ট্রেনিং, আদব-তমিজ, লেহাজ-সোহবত নিয়ে কালোয়াতি শুরু করলেন কেন? ইনার মতলবটা কী? এঁর ঘাড় থেকে পাকিদের ভূত কি এখনো নামেনি নাকি?
জি না, ও রকম কিছুই না। ওইসব ট্রেনিংয়ের সবই যে খারাপ ছিল তা-ও মনে করার কোনো কারণ নেই। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক, তাঁদের মিল-মহব্বত, আদব-কায়দা, প্রশিক্ষণ প্রদান-পদ্ধতি কমবেশি আগের মতো এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। থাকতে হবে, নইলে অনেক সুন্দর ঐতিহ্য লোপ পেয়ে যাবে, বিনষ্ট হয়ে যাবে শাসনব্যবস্থার অনেক মূল্যবান পরম্পরা। আর ওই কালোয়াতি যে কেন করলাম তা বুঝবেন একটু পরেই। আপাতত একটু ধৈর্য ধরুন, প্লিজ।
(৩)
আমি সম্প্রতি খুবই দুশ্চিন্তিত জনপ্রশাসনের সেই সব গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য নিয়ে, যা আঁকড়ে ধরে রেখে আমরা সব সময় গর্ববোধ করেছি এবং আশা করেছি, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে দেশপ্রেম, সততা, সাধুতা, শিষ্টাচার ও নম্রতার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে। ওই শিক্ষা, ওই ঐতিহ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন সিএসপি অফিসার কুদরত-ই-ইলাহী চৌধুরী (১৯৬৪ ব্যাচ, বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর অগ্রজ), এ কে শামসুদ্দিন (১৯৬৭), এ কে এম শামসুল হক খান (১৯৬২) কিংবা নূরুল আমিন খানকে (১৯৬১), একজন ইপিসিএস কর্মকর্তা সাইফ মীজানুর রহমানকে- এবং তাঁদের মতো সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন সার্ভিসের আরো অসংখ্য অফিসারকে- অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে স্বাধীনতার অগি্নশপথে জ্বলে উঠে জীবন উৎসর্গ করতে উদ্দীপ্ত করেছিল। 'সম্মুখে দাঁড়াতে হবে উন্নত মস্তক উচ্চে তুলি- / যে মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা, দাসত্বের ধূলি/আঁকে নাই কলঙ্কতিলক'- শুধু এই মূলমন্ত্র বক্ষে ধারণ করে সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য, আদর্শের জন্য সেদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন তাঁরা। তাঁদেরই উত্তরসূরি আমরা। বুকের রক্ত দিয়ে যে পুষ্পকানন তাঁরা রচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের জন্য, আমরা কি তার পরিচর্যা না করে ক্ষমতার মোহে, বিত্ত-বেসাতের কুহকে আটকে পড়ে কেবলই বিশ্বাসঘাতকতা করতে থাকব তাঁদের রক্তের সঙ্গে? আমি জানি, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আমার বন্ধু, সহপাঠী ও সহকর্মী কুদরত-ই-ইলাহী চৌধুরী তাঁর আজন্মলালিত ন্যায়নীতি ও আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। এমনি আরো অনেকে।
জনপ্রশাসনকে বিকৃত ও বিক্রি করতে করতে, ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার মদমত্ততায় আমরা নিজেদের এক নিকষ কালো অন্ধকার বিবরের করুণাভুক পদলেহী জীবে পরিণত করেছি। আমরা নাকি সমাজের সবচেয়ে মেধাবী শ্রেণীর মানুষ! হয়তো তা-ই। কিন্তু যে মেধা অহর্নিশ কেবল হাতের তালু কচলাতে কচলাতে হস্তরেখা বিলুপ্ত করার কাজে নিয়োজিত, যে মেধা কোদালকে চামচ আর চামচকে কোদাল বলতে বলতে রাত-দিন ৩০ ঘণ্টা (৬ ঘণ্টা দেখানো হয় ওভারটাইম!) ব্যস্ত, 'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে'- স্কুল-কলেজে এসব অমর বাণীর ভাব-সম্প্রসারণ করে দশে দশ পাওয়ার পর কর্মজীবনে অন্যায় করা ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াকেই যে মেধা জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে আঁকড়ে ধরে থাকে, সেই মেধার কোনো প্রয়োজন নেই এই জাতির। তার চেয়ে হাজার গুণে ভালো একজন সৎ কৃষক, মধ্যপ্রাচ্যের ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গনগনে সূর্যের নিচে গাঁইতি-শাবল চালানো বাংলাদেশের ডাকাবুকো জোয়ান ছেলেটি, একজন নিষ্ঠাবতী পরিশ্রমী গার্মেন্ট বালিকা।
দেশের শতকরা নিরানব্বই জন লোক বলছে ক চোর, ক-কে ধরো, জেলে পুরো, খ খুনি, খ-য়ের হাত রক্তরঞ্জিত, ওকে ধরে ফাঁসি দাও, আর আমরা মুষ্টিমেয় কিছু লোক র-য়ে রাজনীতি, ক্ষ-তে ক্ষমতা, ব-য়ে বিরোধী দল, ই-তে ইউনূস ছাড়া বাকি বর্ণমালার দিকে তাকাব না- এ কেমন কথা। আমরা ইতিহাস বিকৃতির কথা বলি, ঠিক আছে, ইতিহাস বিকৃতি খুবই নিন্দনীয় কাজ, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমরা যখন প্রশাসনের চিরায়ত নিয়মকানুনকে পদদলিত করে একপাল চাটুকারকে শুধু 'ডিএনএ টেস্টে' উত্তীর্ণ বলে রাজনীতিতে শীর্ষস্থানে বসাই, চাকরিতে ঢোকাই, প্রমোশন দিই, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বানাই, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পাকাপোক্ত স্থান করে দিই, তখন এগুলোকে কী ধরনের বিকৃতি বলব? ইতিহাস বিকৃতি যেমন আমাদের জ্ঞানের রাজ্যকে করে কীটদুষ্ট, জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম-অবিচার তেমনি পুরো জাতিকে করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, পঙ্গু, হতাশায় নিমজ্জিত।
(৪)
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো তফসিলি ব্যাংক ও অর্থ-প্রতিষ্ঠানগুলোর খবরদারি করা, এগুলোর পরিচালকরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, না লুটপাটে মদদ দিচ্ছেন দেখা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে এটা কেবল তাদের আইনি দায়িত্বই নয়, নৈতিক কর্তব্যও বটে। আর তারা যখন বলল, অমুক ব্যাংকের পরিচালকদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ধরা পড়েছে আমাদের চোখে, উই স্মেল র‌্যাট, আমাদের কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে, এদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতিতে মদদ দেওয়ার, এদের সরিয়ে নতুন লোক দিন, তখন আমরা, অর্থাৎ যারা এসব দেখাশোনা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নামক পাহারাদার রেখেছি, তারাই কিনা কষে এক ধমক লাগালাম পাহারাদারকে : এসব ব্যাপারে নাক গলানো তোমার কাজ না, তুমি শুধু রাত জেগে 'খবরদার, খবরদার হো' বলে হাঁক দেবে, কে চোর, কে ডাকাত, লুটপাটের মদদদাতা হিসেবে কাকে সরাতে হবে, এগুলো দেখার এখতিয়ার নেই তোমার, তুমি শুধু 'খবরদার হো' বলে চিৎকার দিয়েই নাসিকায় তৈল ঢেলে সুখে নিদ্রা যাও। তুমিও ঘুমাও, আমরাও ঘুমাই আরামে। আর জাতিকে কথামৃতের আফিম সেবন করিয়ে কী করে কুম্ভকর্ণ বানাতে হয় সে বিদ্যা আমরা ভালো করেই জানি।
হায়, আমাদের জীবদ্দশায় এও দেখতে হলো। পাকিস্তানিরা একটি জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, আর সেই জাতিকে কতিপয় দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, মেরুদণ্ডহীন পা-চাটার দল গোর-কাফন ছাড়াই জীবন্ত পুঁতে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। আর বলিহারি! আমাদের চোখে এখন এমন মায়া-অঞ্জন লেগেছে যে আমরা সহসাই হয়ে গেছি সৌদি আরবের বাদশা নামদার, ব্রুনেই দার-আস-সালামের সম্রাট কিংবা ধনকুবের বিল গেটস্। আমরা এখন চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকাকে টাকাই মনে করি না। কথাটা শুনে প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম, এটা বোধ হয় মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের রসিকতা। তবে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিয়ে নিঃসন্দেহে এ ছিল তাঁর এক ধরনের বদ রসিকতা, যা মাননীয় মন্ত্রীর পরিপাকযন্ত্রে দ্রুত বদহজমের সৃষ্টি করেছিল : তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন (জাতির কাছে?)। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে সততার 'হলমার্ক' যে কম্পানি ভানুমতির খেল দেখিয়ে রাতারাতি দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করল, তার কর্তাব্যক্তিটি কদিন আগেই মাননীয় মন্ত্রীর এখতিয়ারবিষয়ক উক্তিতে যেভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন, সর্বশেষ ক্ষমা-টমা চাওয়ার পর আবার চুপসে গেছেন ফুটো হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো। তাঁর কোনো পীর হুজুর হয়তো তাঁকে বলবেন, ঘাবড়াও মত্ বেটা, ইয়ে বাংলাদেশ হায়, ইঁহা ঘণ্টায় ঘণ্টায় দৃশ্য বদলাতা হায়। সব ঠিক হো যায়গা।
কিন্তু শুধু ক্ষমা চাওয়া-চাওয়িতেই কি শেষ হয়ে যাবে জাতির পকেট মেরে সরিয়ে নেওয়া চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকার এই নজিরবিহীন জালিয়াতি? জাতি কি জানতে পারবে না কার হুকুমে, কাদের বলে বলীয়ান হয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা এই সূর্য-লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হয়েছিল? একজন অখ্যাত অবজ্ঞাত ভুঁইফোঁড় ব্যবসায়ীর হাতে চোখ বুজে হাজার হাজার কোটি টাকা কোন ডাইরেক্টররা তুলে দিয়েছিল? কার নির্দেশে? আর কার কার হিস্যা আছে ওই তথাকথিত ঋণের টাকায়? রেলের এটেনডেন্ট ছোকরা ১০-২০ টাকা ঘুষ নেওয়ার জন্য এক মন্ত্রীর চড় খেয়ে নিজের গাল ধন্য হয়েছে মনে করতে পারে, করুক; কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট সবাই গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াবে, এটা কোন বিচার? আজ পর্যন্ত (১০.৯.১২) একটা মামলা নেই, গ্রেপ্তার নেই, অথচ অনেক কাল্পনিক অপরাধের জন্য জেল-জরিমানা-রিমান্ড-'খরচফায়ারে' জীবন বাজে খরচ হওয়ার ঘটনা আকছারই ঘটছে।
(৫)
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনি যেদিন মহান জাতীয় সংসদে ক্ষমা চাইলেন, এককালে আপনার একজন জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে, আপনার (বৃহত্তর) সিলেট জেলার একজন নগণ্য অধিবাসী হিসেবে, লজ্জায়-দুঃখে-ক্ষোভে সেদিন আমার (এবং বোধ করি আরো অনেক সিলেটির) মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মারদাঙ্গা সিরিজের 'রাবিশ', 'নন্সেন্স' 'দুষ্টু' ইত্যাদি রোমহর্ষক পুঁথি-পুস্তকের পর সর্বশেষ সাড়া জাগানো গ্রন্থের শিরোনাম হবে 'ক্ষমা চাই, হে দেশবাসী'! এত দিন এত দাব-রোয়াব, তুড়ি মেরে সব কিছু উড়িয়ে দেওয়ার দুর্মর প্রবণতা, এমনকি হিলারি ক্লিনটনকেও একটুও ছাড় না দেওয়া, আর শেষ পর্যন্ত কিনা গলবস্ত্র হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন নিজেরই বেফাঁস মন্তব্যের জন্য। আপনি ইংরেজি সাহিত্যের এককালের নামকরা ছাত্র। জানি না, আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে এই জব্বর এন্টি-ক্লাইমেঙ্ বা বেথস্ বাজারে ছাড়লেন কি না বইয়ের কাটতি আরো বাড়ানোর জন্য!
আপনি আমাদের অনেক সিনিয়র, আমাদের অনেকের নমস্য 'রোল মডেল', গুরু। গতকাল (৯.৯.১২, রোববার) টিভিতে শুনলাম আপনি বলছেন, প্রায় ৯ মাস ধরে আপনি নাকি দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। হয়তো নানা কারণে আপনি তিতি-বিরক্ত ও হতাশ। এমন একটা ইচ্ছা আপনার মনে জাগতেই পারে। (আশপাশে সব কিছুর যে মাজুল অবস্থা, তাতে 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' ধরনের একটা ইচ্ছা মনে না জাগাটাই বোধ হয় অস্বাভাবিক।) আমরাও তাই কই : 'বালা না লাগলে হাছাউ যাউক্কা গিয়া আপনে, তও, নিজেরে ছুটো করউক্ক না।' (ভালো না লাগলে সত্যি চলে যান আপনি, তবু নিজেকে ছোট করবেন না)।
উপসংহার : যদ্যপি মোর গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়/তদ্যপি মোর গুরু নিত্যানন্দ রায়। কিন্তু গুরু, সব কিছুর যেমন শুরু আছে, তেমনি শেষও আছে। 'মুহিত, তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'- এই স্লোগানধারীরা পেছন থেকে কেটে পড়ার আগে আপনি নিজেই কেটে পড়বেন কি না সিরিয়াসলি ভেবে দেখতে পারেন। হঠাৎ হয়তো দেখবেন, আপনাকে মগডালে তুলে সব কয়টা মই সরিয়ে নিয়েছে ওইসব সুপার চালাকরা, যারা গল্পের বানরের মতো দইটুকু চেটেপুটে খেয়ে হাত মুছতে অভ্যস্ত বেচারা নিরীহ ছাগলের দাড়িতে।
আপনার আমার সিভিল সার্ভিসের শিক্ষা, ঐতিহ্যও তো বলে : সব কিছুর ঊধর্ে্ব সম্মান, মর্যাদা এবং সর্বোপরি কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত
না করা।

লেখক : সাবেক সচিব
mkarim06@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.