শেকল ছেঁড়ার কাহিনী

আমার বয়স যখন আঠারো, আমার বাবা-মা সে সময় আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং তারা যথাযথ অর্থেই সে হুমকি দিয়েছিল। যদি তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারত তাহলে আজ আমি জীবিত থাকতাম না। আমার বয়স যখন পনেরো, সঙ্কটের শুরু তখন থেকে। সে সময় আমাদের পরিবার অস্ট্রিয়ার লিন্জ শহরে বসবাস করত।
এটি আমার জন্মভূমি পাকিস্তান থেকে বহু দূরে। পাকিস্তানের যে প্রত্যন্ত গ্রামে আমি বেড়ে উঠেছিলাম সেটা ছিল কাশ্মীর পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ায় এসে আমি আমার নতুন জীবনের স্বাধীনতাকে ভালবেসেছিলাম। পছন্দ করতাম টি-শার্ট ও জিন্স পরতে, লিপস্টিক ও আইলাইনার ব্যবহার করতে। কিন্তু আমার রক্ষণশীল বাবা-মা তা পছন্দ করত না। আমি সাঁতার শেখা এবং অভিনয় ক্লাসে যোগদানের ব্যাপারে তাদের সম্মতি আদায়ের জন্য তাদের সঙ্গে রীতিমতো ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত হতাম, কিন্তু আমার বাবা বলতÑ এসব খারাপ মেয়েদের (বেশ্যা) কাজ। মাসিক ঋতুস্রাবকালীন ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিনও ছিল একটি ইস্যুÑ আমার মায়ের ধারণা ছিল, তা আমার কুমারিত্ব ধ্বংস করবে। একদিন আমার মা যখন আমার ব্যবহৃত ডায়েরি দেখে জানতে পারল যে, স্কুল শেষে পার্কে আমি একটি ছেলেকে চুমু খেয়েছি তখন আঘাতে আঘাতে সে আমার সারা গাল ছিঁড়ে-ফেঁড়ে মিসমার করে দিল। আমাকে দেয়ালের সঙ্গে সজোরে আঘাত করল এবং আমাকে বেশ্যা বলে গালি দিয়ে সে আমাকে পদাঘাত করল। সে যখন আমার বয়সী ছিল, তখন তার বিয়ে হয় পরিবারের সম্মতিতে। তার ধারণা, আমারও তেমনটি করার সময় হয়েছে। কিন্তু আমি তাতে রাজি হলাম না। এভাবেই আমার মায়ের সঙ্গে আমার তিন বছরব্যাপী ভয়াবহ ‘লড়াই’ চলে। আমার মতো উপজাতীয় সংস্কৃতির উৎসে লালিত পরিবারসমূহে বিয়েই হলো একটি মেয়ের জন্য শেষ ঠিকানা। আর এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে পিতারা সবসময় জোরজবরদস্তি করে নাÑ মায়েরাই তা করে। আমার মতে এটি আরও বেশি খারাপ। আপনি যখন পুরোদস্তুর একজন যুবতী নারী হয়ে উঠছেন এবং আপনার মা আপনাকে প্রহার করছে, তখন এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়। তখন আপনার কোন নিরাপদ অবলম্বন থাকে না।
আমার মা আমার প্রতিটি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। একদিন সে আমার একটি টি-শার্ট দেখল এবং তার মনে হলো এটি খুবই ছোট, আঁটসাঁট। তখন সে আমার মুখে জুতো দিয়ে প্রচ- আঘাত করে, তাতে আমার ঠোঁট কেটে যায়। এতদসত্ত্বেও আমি নতিস্বীকার করলাম না। একটি জবরদস্তি বিয়েকে মেনে নিয়ে আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলাম না। আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা, আত্মমুক্তি। আমার বাবা-মায়ের দৃষ্টিতে আমার বিদ্রোহই ছিল তাদের লজ্জা-অপমানের মূল উৎস। এতে তারা অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী অন্য পাকিস্তানী দম্পতিদের মাঝে অপমানিত বোধ করতে লাগল। তারা আমাকে বিয়ে দিয়ে পারিবারিক ‘সম্মান’ পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে দৃঢ়সংকল্প হলো। আমার বয়স যখন ষোলো, তখন আমার পরিবার পাকিস্তান সফরে গেল। মনে পড়ে, একদিন আমি বাইরে হাঁটতে গেলাাম। আমার পরনে ঢোলা প্যান্ট ও ব্লাউজÑ আমার ধারণায় তা ছিল পুরোপুরি শালীন, ভদ্র। কিন্তু অন্যরা তা ভিন্নদৃষ্টিতে দেখল। একদঙ্গল মানুষ জড়ো হয়ে আমাকে ঘিরে অবজ্ঞাসূচক শিস্ ও টিটকারি দিতে লাগল। ওইদিন বাড়িভর্তি আত্মীয়-স্বজনের সামনে আমার মা আমাকে আবার পেটালো। তারপর সে নিজেই নিজের শরীরে আঘাত করতে লাগল। আমি জানতাম যে, পাকিস্তানীদের মধ্যে এমন মানুষ আছে যারা দুঃখ-সংকটে পড়লে নিজের শরীরে আঘাত করে। কিন্তু আমি কখনও বিশ্বাস করতে পারিনি যে, আমার নিজের মা সেটা করছে। আমি দেখলাম, সে একটি রড দিয়ে ক্রমাগত নিজের বুকে আঘাত করছে এবং বলছে : ‘আমি একটি বেশ্যাকে পেটে ধরেছিলাম!’
আমার বাবা-মা আমাকে লাহোরে এনে এক মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলÑ আমার মায়ের কথিত ‘শিক্ষালাভের’ উদ্দেশে। ত্রিশটি মেয়ের সঙ্গে একটি ঘরে আমি থাকতাম। কোন চেয়ার ছিল না, বিছানাপত্র ছিল না; ঘরে বাতাস চলাচলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ওই ঘরে আমরা সারাদিন কোরআন শিখতাম, নামাজ পড়তাম এবং ইসলামের নবী সম্পর্কে ধর্মশিক্ষকের বক্তৃতা শুনতামÑ যিনি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বয়ান করতেন। সারাদিনে আমাদের আর কোন কাজ ছিল না। বক্তৃতা চলাকালে কোন মেয়ে যদি নিয়মবহির্ভূত সময়ে কথা বলত, তাকে বাইরের আঙিনায় দাঁড় করিয়ে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হতো। মাদ্রাসার ওয়াশরুম অগুনতি মাছি ও পোকামাকড়ে কিলবিল করত। সেখানে কোন স্যানিটারি ন্যাপকিন ছিল না, ছিল স্রেফ রক্তমাখা কিছু তোয়ালে। মাটিতে খনন-করা একটি গর্ত ছিল টয়লেট। তিন মাস পর আমি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলাম এবং আমাকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হলো। অবশেষে আমার পরিবারের পছন্দ-করা এক ব্যক্তিকে আমি বিয়ে করতে রাজি হলাম, যাতে এনগেজমেন্টের সময় আমি অস্ট্রিয়ায় ফিরে যেতে পারি। পরবর্তীতে আমার বাবা-মা যখন বুঝতে পারল যে, সত্যি সত্যি আমি বিয়ে করতে ইচ্ছুক নই তখন আমার বাবা আমাকে বলল : ‘এই পরিবারের সম্মান আমার বা তোমার জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ এটি ছিল আমার জীবনের ওপর সরাসরি হুমকি। কথাটি শুনতে অতিশোয়োক্তি মনে হতে পারে; কিন্তু এমনই ঘটছে। জাতিসংঘের এক হিসেবমতে তথাকথিত অবাধ্যতা ও অশালীনতার মাধ্যমে পরিবারকে ‘অপমানিত’ করার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে পাঁচ হাজার মহিলা ও বালিকাকে হত্যা করা হয়।
আমি পালালাম। লিনজের একটি ক্যাফেতে চাকরি করে এবং একটি আশ্রয় কেন্দ্রে রাতে ঘুমিয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে লাগলাম। আমার বাবা-মা আমার বিয়ের কথা প্রকাশ ও বিয়ে করতে জবরদস্তি হুকুম দেয়ার মাধ্যমে দুই জায়গাতেই আমাকে নাজেহাল করতে লাগল। যতদিন না আমি আমার চাকরিটি হারালাম ততদিন তারা রোজ বেসামাল পিশাচের মতো আমাকে ঘিরে থাকল। আমি আঠারোয় পা দিলাম। বন্ধুদের সহযোগিতায় আমি ভিয়েনায় পালিয়ে গেলাম। সেখানে নাম পরিবর্তন এবং ক্যাথোলিক ধর্ম গ্রহণ করে আমি নতুন জীবন শুরু করলাম। আমি আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখলাম। তাতে আমার বাবা-মা আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করল। কোর্ট আমার পক্ষে রায় দিল। ‘হয় বিয়ে করো, না হয় মরো’Ñ আমি আজ এই কুপ্রথা ভাঙ্গার চেষ্টা করছি। আমি জার্মানিতে সাবাতিনা নামে একটি ফাউন্ডেশন পরিচালনা করছি, যেখানে আমি বাস করি। আমার কর্মীগ্রুপ ভূগর্ভস্থ রেলপথের মতো কাজ করেÑ পরিবার থেকে পালিয়ে-আসা অসহায় নারীদের আশ্রয় ও কাজের ব্যবস্থা করছি আমরা।
আমি কদাচিৎ একাকী বাইরে যাই। আমি প্রায়ই বিস্মিত হই, যদি দেখি নতুন-আসা অসহায় নারীদের চারপাশে কেউ ওত পেতে আছে। আমি সবসময় ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে ভালবেসেছি; কিন্তু এজন্য আমাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
অনুবাদ : মুস্তাফা মাসুদ
নিউজ উইক ম্যাগাজিন থেকে

No comments

Powered by Blogger.