সম্প্রসারণ নয় প্রয়োজন গুণগত পরিবর্তন by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করেছেন। আরো সাতজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী শপথ গ্রহণ করলেন। এটাকে এখন পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় রদবদল বলা চলে না। বলা চলে সম্প্রসারণ। কারণ পুরনো মন্ত্রীদের কাউকেই এখন পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়নি। নতুন মন্ত্রীদের কারা কী দপ্তর পাবেন, তাও এখন পর্যন্ত জানি না।


বলা চলে, এটা মন্দের ভালো। আমাদের দাবি ছিল মন্ত্রিসভায় একটি বড় ধরনের রদবদল। অযোগ্য মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করা। যা হলো, এটা এক ধরনের গোঁজামিল। তাতে মন্ত্রিসভার দক্ষতা কতটুকু বাড়বে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে, তা বলা মুশকিল। সাধারণত সংখ্যা বাড়িয়ে মন্ত্রিসভার শক্তি বাড়ানো যায় না। সংখ্যায় কম হোক, দক্ষ মানুষ চাই কেবিনেটে। এই সম্প্রসারণে মন্ত্রিসভার দক্ষতা কতটা বাড়ে তা দেখার রইল।
লক্ষণীয় ব্যাপার, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন আমন্ত্রিত হয়েও মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। জাসদের হাসানুল হক ইনু দিয়েছেন। তোফায়েল ও মেননের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়ার একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। আমার ধারণা, তোফায়েল আহমেদ আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা ও সাবেক দক্ষ মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এক-এগারোর সময়ের ভুল বোঝাবুঝির দরুন তাঁকে গোড়াতেই মন্ত্রিসভায় না নেওয়ায় তিনি অনেকটা অভিমান করেই এই সরকারের একেবারে শেষ সময়ে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে চাননি। অন্যদিকে রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিসভায় না আসাটা আরো তাৎপর্যপূর্ণ। এটা হয়তো আভাস দেয় যে, আগামী নির্বাচনে তাঁর দল মহাজোটে থাকবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। মন্ত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ পাওয়ার পর মেনন তাঁর দলের পলিটব্যুরোর সভা ডেকেছিলেন। পলিটব্যুরো তাঁর মন্ত্রী হওয়াকে অনুমোদন দেয়নি। তাতে মনে হয়, ওয়ার্কার্স পার্টি দুটো বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েছে। একটা হলো, আগামী সাধারণ নির্বাচনে তারা মহাজোটে থাকবে কি না তা নিশ্চিত নয়। দ্বিতীয়ত, সরকারের আয়ু আর মাত্র এক বছর সাড়ে তিন মাস- গত সাড়ে তিন বছরে সরকার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। এবং সরকারের ব্যর্থতাও অনেক। এখন শেষ সময়ে মন্ত্রিসভায় সরাসরি যোগ দিয়ে সরকারের বড় বড় ব্যর্থতার দায়ভাগ নিতে চায় না।
আমরা বহুদিন থেকেই দাবি করে আসছিলাম, মন্ত্রিসভায় একটা ব্যাপক রদবদল দরকার। এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যেই ধরা পড়ে যায়, মন্ত্রিসভার অধিকাংশ নতুন মুখ অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে যাঁরা দক্ষতা দেখাতে পারবেন না, তাঁদের বাদ দেওয়া হবে। তিনি তা করেননি। ফলে সরকারের অনেক আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও অনেক ভালো কাজ তারা শেষ করতে পারেননি। যেসব ভালো কাজ সরকার করেছে, সেগুলো জনগণের সামনে ভালোভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। এ জন্য অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রীর সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এবং অন্যান্য দেশের মতো মন্ত্রিসভায় রদবদল করা প্রয়োজন ছিল। সব গণতান্ত্রিক দেশেই এটা হয়ে থাকে। মিসেস মার্গারেট থ্যাচার কয়েক দফা তাঁর অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী পদে কয়েক দফা রদবদল করেছেন। ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন গত সপ্তাহে তাঁর মন্ত্রিসভায় রদবদল করেছেন। এই ধরনের রদবদলে মন্ত্রিসভার দক্ষতাও বাড়ে এবং জনগণের মনেও সরকারের প্রতি আস্থা সহজে নষ্ট হয় না। আমি জানি না, শেখ হাসিনা কেন তাঁর কয়েকজন উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে তাঁদের অদক্ষতা সত্ত্বেও দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর স্ব-স্ব পদ আঁকড়ে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। এখনো যা করেছেন, তা রদবদল নয়, মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ মাত্র। ক্ষমতায় থাকার শেষ বছরে এসে এই জোড়াতালি দেওয়া সম্প্রসারণ কতটা কাজে দেবে, তা বলা মুশকিল।
যদি এই সম্প্রসারণের পর তথ্য, স্থানীয় সরকার ও সমবায়, বেসামরিক বিমান চলাচল, স্বরাষ্ট্র; ডাক, তার ও টেলিফোন, এমনকি অর্থ মন্ত্রকেও রদবদল হয় এবং দক্ষ ও নতুন মুখ দেখা যায়- তাহলেই এই সম্প্রসারণে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। তা না হলে দেখা যাবে 'থোড়-বড়ি-খাঁড়া'- মন্ত্রিসভার মুখ বেড়েছে কিন্তু দক্ষতা বাড়েনি।
মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ হলো, তাতে এটা প্রমাণ হলো না যে, মহাজোটের ঐক্য বাড়ল কিংবা আগামী নির্বাচনে মহাজোটের ঐক্যবদ্ধ থাকা নিশ্চিত হলো। হাসানুল হক ইনু মন্ত্রিসভায় এসেছেন বটে, কিন্তু রাশেদ খান মেনন আসেননি। এটা যদি ওয়ার্কার্স পার্টির মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আভাস হয়, তাহলে নির্বাচনের আগে মহাজোটে বড় ভাঙন দেখা দিতে পারে। জেনারেল এরশাদ মহাজোটের শরিক এবং তাঁর সমর্থনকে শেখ হাসিনা গুরুত্ব দেন। নতুন মন্ত্রীদের মধ্যে তাঁর দলের কেউ নেই। এটা জেনারেল এরশাদকে মহাজোটে থাকার ব্যাপারে আরো অনুৎসাহিত করতে পারে। তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিসভায় না আসায় মনে হয়, এক-এগারোর সময়ের তথাকথিত সংস্কারবাদী নেতাদের শেখ হাসিনার প্রতি অভিমান অথবা উষ্মা কোনোটাই কাটেনি। আগামী সাধারণ নির্বাচনে তাঁদের এই উষ্মা আরো প্রবলভাবে দেখা দিলে তা আওয়ামী লীগের জন্য অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবে না। এককথায় মন্ত্রিসভার এই সম্প্রসারণ মহাজোটের ঐক্য ফিরিয়ে আনা এবং আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রধানমন্ত্রী ও প্রবীণ নেতাদের মধ্যে দূরত্ব অবসানের কোনো প্রমাণ বহন করে না। মন্ত্রিসভার আয়তন বেড়েছে কিন্তু তার গুণগত পরিবর্তন ঘটবে কি না, তা এখনো দেখার বিষয়।
লন্ডন, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১২। বৃহস্পতিবার

No comments

Powered by Blogger.