শেষবেলায় বড় ধরনের হোঁচট খেল সরকার by উত্তম চক্রবর্তী

মেয়াদের শেষ বেলায় চতুর্মুখী সঙ্কট থেকে উত্তরণে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করতে গিয়েও বড় ধরনের হোঁচট খেল সরকার। গত চার বছরের মধ্যে মহাজোট সরকার এখন সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। দলের অভিজ্ঞ ও পোড় খাওয়া নেতাদের এতদিন সাইড লাইনে রেখে অপেক্ষাকৃত ‘নতুন মুখ’ নিয়ে সরকার পরিচালনার শেষ মুহূর্তে এসে


নানামুখী সঙ্কটের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ছে সরকার। মেয়াদ এক বছর বাকি থাকতে অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে সঙ্কট থেকে উত্তরণ ও দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই হতে হলো শাসক দলের হাইকমান্ডকে।
মহাজোট সরকারের মেয়াদের চতুর্থ বর্ষে এসে দল ও জোটের দুই জ্যেষ্ঠ প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের বহির্প্রকাশ হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এতে করে শাসক দলটি ঘরে-বাইরে আরও চাপের মুখেই পড়বেন বলে তাঁদের ধারণা। সব রাজনীতিকই সোনার হরিণ নামক ‘মন্ত্রিত্বের’ স্বাদ পেতে চান। কিন্তু মন্ত্রিত্বের ডাক পেয়েও তাতে সাড়া না দেয়ার ঘটনা সম্পর্কে বিশ্লেষকদের মতে, “হয় ওই দুই প্রবীণ নেতা শেষ বেলায় মন্ত্রিত্ব নিয়ে সরকারের ব্যর্থতার দায় নিতে চান না, অথবা সঠিক সময়ে মূল্যায়ন না করে সঙ্কট মুহূর্তে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবকে তাঁদের জন্য ‘অপমান’ বলেই মনে করেছেন। এই ঘটনা দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।”
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আকবর আলি খান বর্ষীয়ান রাজনৈতিক তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব বর্জন করার বিষয়ে জনকণ্ঠকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ক্ষমতার লোভ তাঁদের নেই আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। তোফায়েল আহমেদ একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী। রাশেদ খান মেননও প্রবীণ রাজনীতিক। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে তাঁদের মূল্যায়ন না করায় তাঁদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ থাকতে পারে। আমার মনে হয়, শেষ সময়ে এসে তাঁরা হয়ত ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চাননি। যদি তাই হয় তাহলে আমি অবশ্যই তাঁদেরকে সাধুবাদ জানাই।
এ প্রসঙ্গে সাবেক এই আমলা ও অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, মন্ত্রিপরিষদ পুনর্গঠনের বিষয়টি আমি দুইভাবে দেখছি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সরকার রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে। কিন্তু আমার মতে সরকার রাজনৈতিকভাবে খুব একটা শক্তিশালী হবে না। কারণ যাদের মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে দুই-একজন ছাড়া সবাই রাজনীতিতে নবাগত। তিনি বলেন, ৫ মন্ত্রী ও ২ প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে ৫ জনের সংসদীয় আসন রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে। আগামী নির্বাচনে সরকার এই অঞ্চলে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে চায়। তবে আমি মনে করি যাঁদের মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়েছে তাঁরা অভিজ্ঞ। কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতার প্রমাণ পাওয়া যাবে দফতর বণ্টনের পর।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, মহাবিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর এখনই সবচেয়ে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে সরকার। গত চার বছরের মধ্যে মহাজোট সরকার এখন সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। বিশেষ করে, কথিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পুঁজিবাজারে ধস ইত্যাদি ইস্যুতে সব মহল থেকেই তীব্র সমালোচনার মুখে বর্তমান সরকার।
এসব ইস্যুতে বিরোধী দল সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব নেতিবাচক ঘটনা নিয়ে সরকার সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক আবহেরই সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারের এক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে। একই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার আসনও টলায়মান। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই শেষ বেলায় এসে সাতজনকে মন্ত্রিসভায় নেয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বর্তমান মহাজোট সরকারের যে মন্ত্রিসভা শপথ নেয় তাতে জ্যেষ্ঠ নেতারা স্থান পাননি। সংস্কারপন্থী অজুহাতে দলের অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতাদের সাইড লাইনে রেখেই গঠন করা হয় অপেক্ষাকৃত নতুন মুখ নিয়েই মন্ত্রি সভা। কিন্তু সরকারের ঠিক পৌনে চার বছরের মাথায় বিভিন্ন অভিযোগ, মন্ত্রণালয়ের মন্থর গতি এবং নানা দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন সরকারের বেশ কয়েক মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। পদ্মা সেতু ইস্যুতে ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।
সূত্র জানায়, দিনের পর দিন দলের সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়নে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে। অসম্মানের দুঃখ বুকে নিয়েই পরপারে চলে গেছেন দলটির বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুর রাজ্জাক। গত চারটি বছর ধরেই আওয়ামী লীগের হয়ে ষাটের দশক থেকে এ পর্যন্ত রাজপথ কাঁপানো প্রবীণ রাজনীতিক আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল কোন মূল্যায়ন পাননি নিজ দল ও সরকার থেকে। সংস্কারপন্থী ইস্যুতে ঝরে গেছেন বেশ কয়েকজন ডাকসাইটে সাবেক ছাত্রনেতা ও কেন্দ্রীয় নেতা। এতদিন অবমূল্যায়নের পর সরকারের শেষ বেলায় মন্ত্রিত্বের আহ্বান যে মোটেই সম্মানজনক ছিল না, তা বৃহস্পতিবার তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রী হিসেবে শপথ না নেয়ার ঘটনায় বড় প্রমাণ বলেই মনে করছেন দলটির তৃণমূল নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরেই গুঞ্জন ছিল তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রী হচ্ছেন। শোনা যায়, সর্বশেষ গত নবেম্বরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রী করার সময়ও শপথ নেয়ার জন্য বলা হয়েছিল এই প্রবীণ রাজনীতিককে। তখনও তিনি রাজি হননি। বুধবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছ থেকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুরোধ জানানোর পরও সাড়া দেননি তোফায়েল আহমেদ। তাঁকে রাজি করাতে সরকার ও দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে লবিং ও অনুরোধ জানানো হলেও বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ও ’৬৯ গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্বের লোভনীয় প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিতে এতটুকুও কুণ্ঠবোধ করেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মতে, এতদিন অবমূল্যায়নের পর শেষ বেলায় মন্ত্রিত্ব দেয়া সম্মানের চেয়ে তোফায়েল আহমেদের জন্য অসম্মানই বেশি। তাই তিনি মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মন্ত্রিত্ব আমার জন্য বড় কোন কিছু নয়, আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী এটাই সবচেয়ে বড়। আমার মধ্যে কোন ক্ষোভ নেই, হতাশাও নেই। আমি আমার দলকে ভালবাসি, আমার দলেরই সরকার। ব্যক্তি হিসেবে তাঁর মন্ত্রী হওয়া না হওয়ায় কিছু যায় আসে না। এই মুহূর্তে আমি রাজনৈতিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তুত নই। আমি মনে করছি যে এ মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে আমি কিছুই করতে পারব না। আমার মতো একজন তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিসভায় যোগদান না করলে তাতে কিছুই যায় আসে না। আর আমার কাছে মন্ত্রিত্ব থেকে দল বড়। দলের লক্ষ লক্ষ হাজার হাজার কর্মী, তারা এই দলকে সংগঠিত করে রেখেছে, আমি তাদের একজন। সুখে-দুঃখে তাদের সঙ্গে ছিলাম, এখনও আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।
মন্ত্রিসভায় না যাওয়ার ঘটনা বিরোধী দলকে সমালোচনার সুযোগ করে দিতে পারে কি নাÑ জানতে চাইলে তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, বিরোধী দল তো সব বিষয়েই সুযোগ নিতে চায়। এর আর নতুন কী। আমার মধ্যে কোন ক্ষোভ বা হতাশা থাকবে কেন? প্রধানমন্ত্রী যে কোনো সময় ডাকেন, আমি তাঁর নেতৃত্বে কাজ করি। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোন সুযোগ নেই। আমি এখনও আওয়ামী লীগের জন্য জীবন দিতে পারি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু সরকার পরিচালনায় নয়, ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিকদের মধ্যেও সরকারবিরোধী তীব্র অসন্তোষ ক্রমশ জমাট বাঁধছে। ক্ষমতায় আসার প্রথম থেকেই সরকারের ‘একলা চলো নীতি’র কারণে নামে নির্বাচনী জোটটি বহাল থাকলেও বাস্তবে সরকার কর্মকা-ে মহাজোটের কোন অস্তিত্বই নেই। অসন্তোষের বহির্প্রকাশ হিসাবে ইতোমধ্যে মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচনের কথা বলে আসছে। জোটকে পাশ কাটিয়ে আগামী নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন দেয়াও শুরু করেছেন দলটির প্রধান এইচএম এরশাদ।
২৩ দফার ভিত্তিতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলগুলোকে নিয়ে আদর্শিক ১৪ দল গঠিত হলেও নির্বাচনপরবর্তী সরকারের গত চার বছরে শরিক দলগুলো ন্যূনতম ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ও সম্মানটুকুও পায়নি। চৌদ্দ দলের কয়েক দফা বৈঠকে প্রকাশ্য শরিক দলের নেতারা এসব অভিযোগ তুললেও কোন কাজে আসেনি। চৌদ্দ দলের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের একটিও বাস্তবায়িত হয়নি শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একলা চলো নীতির কারণে।
যার সর্বশেষ বহির্প্রকাশ হচ্ছে মন্ত্রিত্বের আমন্ত্রণ পাওয়ার পরও চৌদ্দ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের তা প্রত্যাখ্যানের ঘটনা। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার জন্য ডাক পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসেন ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্যরা। রাশেদ খান মেননের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে অধিকাংশ নেতাই তাঁর মন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। বৈঠকে সরকারের গত চার বছরে শরিক দলগুলোকে আওয়ামী লীগের চরম অসম্মান ও অবমূল্যায়নের ঘটনা তুলে ধরে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন দলটির কয়েক পলিটব্যুরোর সদস্য।
বৈঠক শেষে রাশেদ খান মেনন নিজেই মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মন্ত্রিসভায় আমার শপথ না নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে পলিটব্যুরো। এজন্য আমি শপথ নেইনি। আমার দল মনে করে, ১৪ দলের ২৩ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন ও নির্বাচনে ফল আসে। কিন্তু সরকার পরিচালনায় কোন বিষয় নিয়ে ১৪ দল বা শরিকদের সঙ্গে কোন আলোচনা করা হয়নি। এ পরিস্থিতিতে দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভায় যোগদানের কোন অবকাশ নেই। সূত্র জানায়, রাশেদ খান মেননকেও শপথগ্রহণের জন্য একাধিক জায়গা থেকে অনুরোধ জানানো হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করাতে তারা ব্যর্থ হন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শাসক দল আওয়ামী লীগ এ ঘটনা থেকে একটি বড় শিক্ষা নিতে পারবে। ক্ষমতায় আসার পর একলা চলো নীতি, দলের প্রবীণ নেতাদের অবমূল্যায়নের ফল যে ভাল হয় না এটা অন্তত বুঝতে পারবে দলটির নীতিনির্ধারকরা। আর এই ঘটনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একটি বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করবে বিরোধী দল। মেয়াদের শেষ বেলায় চতুর্মুখী এসব চাপ সামলানোর পাশাপাশি দল ও জোটের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.