শিক্ষা হোক মানবকল্যাণে নিবেদিত by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

ইসলামের নবী হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানবতার জন্য রহমতস্বরূপ। নবুওত প্রাপ্তির পর সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অনুধাবন করেছিলেন শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য। অন্ধাকারাচ্ছন্ন সমাজের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন শুধু শিক্ষা ও জ্ঞান সাধনার মাধ্যমেই সম্ভব;


এটা বুঝে তিনি সমাজ থেকে সব ধরনের অজ্ঞতা ও অপসংস্কার দূর করার নিমিত্তে শুরু করেন শিক্ষা আন্দোলন। এ জন্যই ইসলাম শিক্ষার প্রতি চূড়ান্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং একে ফরজ বলে ঘোষণা করেছে। ইসলাম দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণকর সব জ্ঞান অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়া হলো আখেরাতের কর্মক্ষেত্র। সেজন্য আল্লাহর বিধানগুলো সঠিকভাবে বোঝা, উপলব্ধি করা ও আমল করার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ সাধনই হলো হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) শিক্ষা কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য। এটা আল্লাহতায়ালার নির্দেশনাও বটে।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষা কর্মসূচি হাতে নিয়ে শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?' আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে আরও বলেন, 'যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ দেওয়া হয়েছে।' আর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই বলেছেন, 'আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।' ইসলাম শিক্ষার প্রতি বরাবরই দুর্বল। বর্ণিত কোরআনের আয়াত ও হাদিস এটাই প্রমাণ করে।
আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা নামে দুটি ধারা চলমান। মাদ্রাসা শিক্ষা আবার আলিয়া ও কওমি নামে দু'ভাগে বিভক্ত। সাধারণ শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে জাগতিক উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে। এ লক্ষ্যে বারবার ঢেলে সাজানো হয়েছে এ স্তরের শিক্ষাক্রম। সম্প্রতি আলিয়া মাদ্রাসাও পরিবর্তনের আওতায় এসেছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসা রয়ে গেছে আগের স্থানেই। মাদ্রাসার শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদিও ইসলামী চিন্তা- চেতনাসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা, কিন্তু সেখানে পার্থিব শিক্ষার সঙ্গে যথেষ্ট সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। মাদ্রাসাগুলো বর্তমানে ভালো মানের আলেম উপহার দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে অনেকেই বলে থাকেন, শিক্ষার এ ধারায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুসরণে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম আজও তৈরি করা হয়নি বলেই এ অবস্থা। এ অভিযোগের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হতে পারে সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
মূলত মানবজাতিকে জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর বুকে মানুষকে ক্ষমতাবান করেছেন। মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতার পরিসর সমান্তরাল। তাই জ্ঞান অন্বেষার মাধ্যমে অজানাকে জানা জীবনের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যেভাবে শিক্ষিত হচ্ছি সে শিক্ষা কতটুকু সুশিক্ষা? আমরা যারা লেখাপড়া করছি সেটা কি চাকরির জন্য, না মানবজাতির কল্যাণের জন্য? প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হতো না যদি না শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের পরস্পরে এভাবে মারামারির দৃশ্য বারবার দেখতে হতো।
শিক্ষাঙ্গনে এমন অস্থিরতা ও অনৈতিকতা চলতে থাকলে দেশ ও জাতিকে কারা উন্নতির সোপানে নিয়ে যাবে? তাই তো বলি, শিক্ষিতদের উচিত হবে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। কারণ, বর্তমানে যা ঘটছে তা সম্পূর্ণভাবে নৈতিকতা পরিপন্থী কাজ। এটা যদি আমরা ধর্মীয়ভাবেও চিন্তা করি তাহলে বলতে হয়, কোনো ধর্মের কোথাও উল্লেখ নেই অনৈতিকতার কথা; বিশৃঙ্খলার কথা। আর এটা কে না জানে যে, মানবজীবনে ভালোমন্দ বোঝা এবং চলার পার্থক্যটুকুর নামই নৈতিকতা। মানবজাতির সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক মানব সভ্যতার শুরু থেকেই। নৈতিকতা প্রকারান্তরে ধর্মীয় শিক্ষাই বটে।
আমরা জানি, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আজকের শিক্ষিত ছাত্রসমাজই হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। তাই তাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে জাতীয় প্রয়োজনে। কিন্তু দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যে অস্থিরতা, সন্ত্রাস আর নৈরাজ্য চলছে তাতে শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে শিক্ষা গ্রহণের আশা দুরাশায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রবাদে আছে, 'ছাত্র নং অধ্যয়নং তপঃ' অর্থাৎ অধ্যয়নই ছাত্রদের তপস্যা। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে বিভিন্ন ইস্যুতে অশান্ত পরিস্থিতির ফলে শিক্ষার্থীদের তপস্যার চরম ব্যাঘাত ঘটছে। পড়াশোনার পরিবর্তে আন্দোলনে তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষের মেধা, চিন্তাশক্তি ও মননশক্তি বিকাশের জন্য যত পরিকল্পনাই থাকুক, মানুষের নৈতিকতা বিকাশের পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা যদি সমাজকে অপরাধমুক্ত দেখতে চাই; তাহলে আমাদের অবশ্যই নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার বাইরে যারা আছে তাদের শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া যারা ১৬-১৭ বছর শিক্ষা অর্জন করে স্বীকৃতির বাইরে তাদেরও স্বীকৃতির আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতির বিষয়টি উল্লেখ করার মতো।
একজন শিক্ষার্থী তার অভিভাবক ও শিক্ষকমণ্ডলীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজ প্রতিভাকে বিকশিত করে সফলতা অর্জন করে থাকে। তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর শিক্ষার্থীরা যেন কোনো স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহলের ক্রীড়নক হয়ে নিজেকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে নিয়ে না যায় এ ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকতে হবে।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.