সরকারী ব্যাংক বিক্রির কথা উঠছে কেন, কারা তুলছেন এ কথা? by ড. আর এম দেবনাথ

আজকের কলাম লিখলে লিখতে হয়, ‘হলমার্ক’ ইস্যুর ওপর। কারণ এটাই এখন অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় খবর। হবে না কেন? দেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকসহ মোট প্রায় ২৮টি ব্যাংক থেকে এই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে।


৪০০০ হাজার কোটি টাকা, ভাবা যায়, যদিও এই টাকা দিয়ে শান্তিনগর-সিদ্ধেশ্বরীতে এখন চার কোটি টাকা দরে মাত্র ৫০ বিঘা জমি কেনা যায়। তবু এই টাকা বেশ বড় পরিমাণের টাকা, কারণ এই টাকা দিয়ে এক কোটি মাথাপিছু ধরে ৪০০০ ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়া যায়। এসব কারণে ‘হলমার্ক’ সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। মিডিয়ার প্রচার গুণে এখন শুধু সোনালী নয়, সকল সরকারী ব্যাংকই কাঠগড়ায়। অনেক ‘প-িত’ ব্যক্তি যাঁরা ক্ষমতার স্বাদ এখনও নিচ্ছেন, অতীতেও নিয়েছেন। (সাত বছর অর্থ সচিব) এমন ব্যক্তিরা বলতে শুরু করেছেন, সরকার ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থ। অতএব সরকারের উচিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বিক্রি করে দেয়া। ‘প-িত’ ও ‘টকসুওয়ালারা’ বলতে চাইলেন রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থাকাটাই অপরাধ। কারণ এতেই থাকে ‘রাজনৈতিক’ পরিচালক যাঁদের কাছে সংসদে এখন যাঁরা সোচ্চার তাঁরা তদ্বির করেন। ভুল বললাম কি? ঈশ্বর মাপ করুন। মাফ নিয়ে এখন একটা ঘটনা দেশবাসীর সামনে হাজির করতে চাই। দেশে সবে মাত্র বেসরকারী খাতে ব্যাংক কাজ করতে শুরু করেছে ‘লাঙলের’ মালিক জেনারেল এরশাদের সৌজন্যে। সরকারী ব্যাংকের বিরুদ্ধে আজ যে অভিযোগ উঠেছে তখনও একই অভিযোগ তুলে দুটো সরকারী ব্যাংক বিক্রি করা হয় এবং ছয়টি ব্যাংক নতুনভাবে বেসরকারী খাতে দেয়া হয়। ঈশ্বরের কি মর্জি দুই-চার-ছয় বছরের মধ্যেই আজকে ‘হলমার্ক’ যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে অথচ যার জন্য তারা আসামির কাঠকড়ায় দাঁিড়য়েছে ঠিক একই সমস্যা বেসরকারী ব্যাংকগুলোও সৃষ্টি করে। ধরা পড়ে অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের কাছে। কি ধরা পড়ে? বেনামী ঋণ, ‘কায়দা’ করে অনুমোদিত। ‘ডক্যুমেন্ট’সব দুইনম্বরী। টাকার পরিমাণ আজকের ক্রয়ক্ষমতার হিসেবে চার হাজার কোটি টাকাই হবে। কারা জড়িত? প্রায় সকল নতুন প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংক। কারা জড়িত? বড় বড় সব ব্যাংকার যাঁদের তখনকার দিনে অনেকেই ডাকতেন ‘বাংকার’ বলে। এখন বিচার কি হবে? বিএনপি সরকারের আমল। আশ্চর্য্য, আজকে যেমন হৈ চৈ হচ্ছে ‘হলমার্ক’কে নিয়ে তখন এতটা হয়নি। মালিকদের থানায় সোপর্দ করা, পুলিশে সোপর্দ করা। ক্রিমিনাল মামলার কথাও হয়নি। তাহলে? যেটা তখন হয়েছিল তা হচ্ছে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় একটা ব্যবস্থা হয়। বেনামীতে যাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন তাঁরা ঋণ স্বীকার করে নেন। ঋণ পরিশোধের গ্যারান্টি নেয়া হয়। পার্টিদের সময় দেয়া হয়। যতদূর মনে পড়ে ইন্টারেস্ট মরেটরিয়ামের সুযোগ দেয়া হয়। এই হচ্ছে বেসরকারী ব্যাংকের শুরু। তারপর? তারপর বিগত ২৮-২৯ বছরে বেশ কয়েকটা বসেরকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘পাতকী’ কাজ করে লালবাতি জ্বালানোর উপক্রম করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এদের রক্ষা করে বিশেষ ‘স্কিমের’ অধীনে। সাবেক ‘বিসিসিআই’ (বর্তমান ইবিএল), সাবেক বিসিসিআই ফাউন্ডেশন (বর্তমান ব্যাসিক ব্যাংক), সাবেক আল বারাকা- ওরিয়েন্টাল (বর্তমান আইসিবি ইসলামী ব্যাংক), সাবেক বিসিআই (বর্তমান বিসিআই ব্যাংক) ইত্যাদি তার প্রমাণ। (বেসরকারী ব্যাংকে তো এমন ঘটনা ঘটে যে মালিকরা ‘ক্যাশ ডেবিট ভাউচার’সই করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যায়। আমি আর বাড়াতে চাই না। কেউ বির্তক করতে চাইলে ঈশ্বর চাইলে আমি তা করব-তবে ঝুঁকি আছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘প-িত’ ব্যক্তিরা যদি বলেন বেসরকারী খাতে সরকারী ব্যাংক গেলেই সকল সমস্যার সমাধান হবে তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। এই প-িতদের অনেকেই বিশ্বব্যাংকের অবসর ভাতা নেন, কন্সালটেন্সি করেন। অতএব ওদের প্রেসক্রিপশন মতো কথা বলা ছাড়া তাদের উপায় নেই।
‘হলমার্কের’ বিশদ আলোচনায় যাব না। গত কয়েক দিন যাবত পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন যে খবর ছেপেছে/দেখিয়েছে তাতে এই সমস্যার নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে। খবরে দেখলাম ‘হলমার্কের’ ইস্যুতে দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করছে ব্যাংক। এসব হোক তাতে কার আপত্তি হবে? তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিচার হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। তবে বড় প্রত্যাশা টাকা আদায় করার বিষয়টি। অভিজ্ঞতায় বলে কোন ব্যাংক মামলা করে বকেয়া টাকা অতীতেও আদায় করতে পারেনি, আজও পারছে না। এমতাস্থায় ‘হলমার্কের’ টাকা আদায় হলে দেশবাসী কৃতার্থ হবে। আমি এসব বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে যেতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ‘ভবিষ্যৎ হলমার্ক’ বন্ধ করতে হলে সরকারী ব্যাংকগুলোকে বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মতো চলতে দিতে হবে। তাঁরা স্বাধীনভাবে ‘এমডি’ নিয়োগ করে যা পরে যথা বিবেচনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়। সরকারী ব্যাংকের ‘এমডি’ ‘ডিএমডি,’ আসে ব্যাংকিং বিভাগ থেকে। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনও লাগে। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রে ‘এমডি’ পরিচালকদের ‘ভাই’ বলে থাকনে। এমডির ওপর বোর্ডের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। ‘এমডি’ একবার যান বাংলাদেশ ব্যাংকে। আরেকবার যান ব্যাংকিং বিভাগে। তাঁর আনুগত্য স্বভাবতই নিয়োগকর্তার দিকে। তিনি এই নিয়োগ পেতে যে ‘দেনদরবার’ তদ্বির করেন এতেই যোগ্যতা, মেধা জঙ্গলে হারিয়ে যায়। দোষ হয় শুধু পরিচালকদের। এরা ধোয়া তুলসী পাতা নন। আবার সবাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িতও নন। দুই-একজন থাকতে পারেন। কিন্তু বেসরকারী ব্যাংকের মালিকরাই বড় বড় রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী দলীয় নেতা। বেসকারী ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের ৬৫ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। ঐ জায়গায় রাজনীতিবিদরা সরাসরি সিদ্ধান্ত নিলে, ঋণ বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিলে, নিয়োগ-পদৌন্নতি দিলে তা রাজনীতি প্রভাবদুষ্ট হয় না, হয় সরকারী ব্যাংকের বোর্ডে ১৩ জনের মধ্যে এক-দুই জন রাজনৈতিক পরিচালক থাকলে। ‘আজব’ বুদ্ধিজীবী সমাজ! তাঁদের যুক্তি বোঝা দায়। কথা উঠলে ওঠা দরকার গাছ নিয়ে, ডাল নিয়ে নয়। ত্রিশ যোগ ৯টি ব্যাংক হচ্ছে?/ হবে বেসরকারী ব্যাংক। এগুলোর মালিকানা হবে রাজনৈতিক। রাজনীতি ও অর্থনীতি সেখানে মিশে আছে অথচ সরকারী ব্যাংকে কিঞ্চিৎ মিশলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ‘টকসুওয়ালাদের’ বলব ঐ ইস্যুতে জনমত গঠন করতে, সরকারী ব্যাংক বেসকারী খাতে দেয়ার দাবি নিয়ে নয়। দাবি উঠুক পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে সরকারী ব্যাংকগুলোকেও চলতে দিতে হবে। সরাকারী কর্মকর্তাদের দিয়ে ব্যাংক চালাবেন? এখন পরিষ্কার উচ্চতর আমলারা দলে দলে বিভক্ত। তাদের হাতে কি ব্যাংক নিরাপদ থাকবে? অনেক কথা। জায়গা নেই। ভবিষ্যতে আরও লিখব এই বিষয়ে।

No comments

Powered by Blogger.