‘সিডও’ সনদ ও নারী অধিকার by মিলন আহমেদ

গত ৩ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। সিডও হচ্ছে জাতিসংঘের একটি সনদের নাম। বিশ্বের সকল মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে শান্তি ও প্রগতি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৫ সালে। যার মর্মবাণী হচ্ছে ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষ জন্মগতভাবে সমান মর্যাদার অধিকারী’।


কিন্তু দেখা গেল যে, বিশ্বের দেশে দেশে নারী চরমভাবে অবহেলিত এবং দানবের মতো টিকে থাকা পুরুষতান্ত্রিকতা জাতিসংঘের মূললক্ষ্যকে ব্যাহত করছে। সেকারণে Convention on Elimination of all forms of Discrimination Against women ms‡¶‡c CEDAW (সিডও) নামে একটি সনদ ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ‘সিডও’ হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত সনদসমূহের অন্যতম যার অর্থ দাঁড়ায় ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ’। কাজেই লাখ লাখ বছর ধরে চলে আসা নারীর প্রতি অবিবেচনামূলক বৈষম্য দূরীকরণের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার ফসল হল ‘সিডও’ সনদ। ওই সনদকে বলা হয়ে থাকে ‘নারীর মানবাধিকার দলিল’। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত ওই সনদ ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বব্যাপী কার্যকর হতে শুরু হয়। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর এতে স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষর করা মানেই ‘সিডও’ সনদের সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করা এবং নিজ দেশে তা বাস্তবায়নে অঙ্গিকরাবদ্ধ হওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, স্বাক্ষরের ২৮ বছরেও সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হয়নি।
ইসমত জাহান নামে একজন বাংলাদেশী কূটনীতিক দু‘বছর আগে ব্যাপক সমর্থনের মধ্য দিয়ে ‘সিডও’ এর সদস্য নির্বাচিত হয়ে যথারীতি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, যা বাংলাদেশের জন্য গর্বের। এর আগে ১৯৯৭ সালে প্রথম এশিয়ান হিসাবে বাংলাদেশের সালমা খান ‘সিডও’ এর চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছিলেন, যা ছিল আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তাছাড়া ২০০৬ সালে ফেরদৌস আরা বেগমও ১৮৫টি সদস্য রাষ্ট্রের ১৪০টির সমর্থন পেয়ে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট ‘সিডও’ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই বলা যেতে পারে ‘সিডও’-তে বাংলাদেশ ভালমতোই প্রতিনিধিত্ব করে আসছে।‘সিডও’ সনদের মূলকথা হল উন্নয়ন কর্মকাে নারী যুগ যুগ ধরে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি দান। অন্যভাবে বলা যায় মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বিধানের গুরুত্ব উপস্থাপন করা এবং নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দানই হচ্ছে এই সনদের উদ্দেশ্য। মানবধিকার সংরক্ষণের কথা বলি বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাই বলি না কেন, সব দিক দিয়েই ‘সিডও’ সনদের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি কারণ বিশ্বব্যাপী নারীর অবস্থান এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের নারীরা প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রম করছে এক দুর্বিষহ অবস্থায়। পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও পৃথিবীর মোট আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ নারীর জন্য ব্যয় হয় এবং পৃথিবীর সব সম্পত্তির শতকরা দুই ভাগেরও কম সম্পত্তিতে নারী অংশীদার। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে এ বৈষম্য আরও ভয়াবহ।
বাংলাদেশের নারীরা আজ নির্মমভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে সর্বদাই স্বামী কতৃক আগুনে পুড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে গৃহবধূ। গ্রামে পাটের ক্ষেতে, ভুট্টার ক্ষেতে বা ডোবা-নালায় ধর্ষিতা নারীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। বিষপান করে অথবা সিলিং ফ্যানে ঝুলে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা এদেশের এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক। ৭০ ভাগ নারী এদেশে অপুষ্টি এবং রক্তস্বল্পতার শিকার। প্রসূতি মৃত্যুহার বছরে ২০ হাজার। যৌতুক নামক ভাইরাসে গোটা জাতি আক্রান্ত। নারী হয়ে জন্ম নেয়ার অপরাধে সারাজীবন তাদের নির্যাতিত হতে হয়, নিজের অধিকার এবং প্রাপ্য স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আশ্রিতা হয়ে, পরমুখাপেক্ষী হয়ে, বোঝা হয়ে, দুর্বিষহ যন্ত্রনা নিয়ে নারীকে এদেশে বেঁচে থাকতে হয়। নারীর এহেন দুর্গতির পরও এবং প্রায় তিন দশক পূর্বে থেকে জাতিসংঘের কাছে ওয়াদাবদ্ধ থাকার পরও ‘সিডও’ সনদের প্রধান দুটি ধারা ২নং ও ১৬(১) (গ)নং কেন সরকার বাস্তবায়ন করছে না তা বোধগম্য নয়। শোনা যাচ্ছে উক্ত ধারা দুটি নাকি শরিয়া আইনের পরিপন্থী তাই সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না। ২নং ধারাকে বলা হয়ে থাকে সনদের প্রাণ যার মূল বক্তব্য হচ্ছে “সংবিধান অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত আইনে পুরুষ ও নারীর সমতার নীতি অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকলে তা অন্তর্ভুক্ত করা এবং আইনের মাধ্যমে ও অন্যান্য উপযুক্ত উপায়ে এই নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।” অর্থাৎ ২নং ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং লিঙ্গ-বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের সমতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ১৬(১) নং ধারার (গ) উপধারার মূল বক্তব্য হলো ‘বিবাহের ক্ষেত্রে এবং বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের একই দায়িত্ব এবং অধিকার থাকবে’। নারীর এসব অধিকার অবশ্যই মানবাধিকার। নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতে চাইলে ‘সিডও’ সনদের ২নং ও ১৬(১) (গ)নং ধারার পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো মতেই তা সম্ভব নয়। আজকের বাংলাদেশে নারীকে অসহায় করে রাখার মাধ্যমে যত নিষ্ঠুরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে অন্য কোনভাবে তা হচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধান সম্পূর্ণরূপে ‘সিডও’ সনদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও পরিপূরক। সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে উলেখ করা হয়েছে রাষ্ট্রের সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। ‘নাগরিক’ বলতে এখানে নিশ্চয়ই পুরুষ বা মহিলাকে আলাদা করে বোঝানো হয়নি। তাছাড়া ২৮নং ও ২৯নং এর সব উপধারায়ও নারী পুরুষের সমান অধিকারের অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বর্ণনা রয়েছে। সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’। কাজেই ‘সিডও’ বাস্তবায়নের কাজ আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। তাছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘের সক্রিয় সদস্য এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কৃতিত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এমনিভাবে সবদিকের বিবেচনাতেই ‘সিডও’ বাস্তবায়ন খুবই জরুরী। স্বাক্ষরিত দেশ সমূহকে প্রতি চার বছর পর জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে রিপোর্ট পেশ করতে হয়। প্রতিবারই সিডও কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য অনেক টাকা খরচ করে বাংলাদেশ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি প্রেরণ করে। গত ২৮ বছরে বাংলাদেশ মোট ৭ বার জাতীয় সিডও রিপোর্ট দাখিল করেছে। সর্বশেষ রিপোর্ট দাখিল করেছে ২০১১ সালের শেষের দিকে। প্রত্যেক রিপোর্টেই পূর্ণ সনদ বাস্তবায়নের আশ্বাস রয়েছে। বার বার আশ্বাস দিয়েও সিডও এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা বাস্তবায়ন না করার কারণে সিডও কমিটির সদস্যগণ উদ্বিগ্ন। তারা সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জন্য যে দুটি ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা হল প্রথমত সংবিধানে প্রদত্ত নারী-পুরুষের সমতাকে উপেক্ষা করে সরকারের পক্ষে এখনো বৈষম্যমূলক আইনসমূহকে বজায় রাখা ও সিডও সনদের ২নং ও ১৬ (১) (গ)নং ধারার সংরক্ষণ বহাল রেখে বৈষম্যকে আরও জোরদারকরা এবং দ্বিতীয়ত আশঙ্কাজনক হারে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি ও এর নিষ্ঠুরতম বহির্প্রকাশ যথা এসিড নিক্ষেপ, ফতোয়া, যৌতুক বলি এবং নারীপাচার রোধে সরকারের ব্যর্থতা। বর্তমানে দেশে পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকারের অবহেলা। সরকারের এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কুসংস্কার টিকিয়ে রেখে নারী নির্যাতন বাড়াবে, না-কি ‘সিডও’ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করে এবং সংবিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক পারিবারিক আইন চালু করবে। এই মূহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত একটি সভ্য জাতি হিসাবে আমরা গড়ে উঠব না কি কুসংস্কারের অন্ধকারে যুগ যুগ ধরে ডুবে থাকব।
এবছর সিডও দিবসে (০৩/০৯/২০১২) সনদের ২নং এবং ১৬(১)(গ) ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের দাবিতে মহিলা পরিষদ এবং ৪২টি মানবাধিকার ও উন্ন্য়ন সংস্থার যৌথ প্লাটফরম সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডও বাংলাদেশের উদ্যোগে ঢাকায় পালিত হলো বিভিন্ন কর্মসূচী। আয়শা খানমের সভাপতিত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হলো মহিলা পরিষদের আলোচনা সভা। সভার বিশেষ অতিথি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. শাহ আলম আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে সনদের ২নং এবং ১৬(১)(গ) ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার চেয়ে সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে নারীবাদী সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। কারণ নারীর অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হলে সমাজে নারী-পুরুষের প্রচলিত প্রভু-দাসীর ভূমিকা বদলের প্রয়োজন জরুরী। আইনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতা ও নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা শুধু নারী সমাজের প্রতি হুমকিস্বরূপ নয়, বাংলাদেশের জাতীয় অগ্রগতিতে বিরাট প্রতিবন্ধক। নারী ও পুরুষ একে অপরের সহযোগী, উভয়ই সমানভাবে মানুষ এবং অধিকারের ক্ষেত্রে কোন তফাৎ নেই, এইরূপ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠা সমাজের সব ক্ষেত্রে জরুরী। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে সরকার যৌতুকবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। যৌতুক নিরোধ আইন চালু করেছে এবং তা কার্যকর আছে ভালভাবেই। একে বাস্তবায়নের জন্য যৌতুকের বিপক্ষে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা চিরতরে উচ্ছেদ করতে এবং একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে অবশ্যই ‘সিডও’ সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা এই মুহূর্তের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

লেখক : কলেজ শিক্ষক এবং নারীবাদী কলামিস্ট, ঈশ্বরদী, বাংলাদেশ।
milon.ahmed8@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.