শেকড়ের ডাক-রেলের চাকা, রেলের জমি by ফরহাদ মাহমুদ

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বর্তমান রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কাউকে উচ্ছেদ করা নয়, রেলওয়ের জমি উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁর আগের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, বেদখল হয়ে যাওয়া রেলওয়ের ভূমি উদ্ধার করে বিক্রি করা গেলে অন্তত আগামী তিনটি বাজেটের অর্থের জোগান দেওয়া যাবে।


তিনি এ কথা বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন, সারা দেশে রেলওয়ের কী বিপুল পরিমাণ জমি স্বার্থান্বেষীরা গ্রাস করে নিয়েছে। এর আগেও দু-একজন যোগাযোগ বা রেলমন্ত্রী এ ধরনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাস্তবে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই একই তিমিরে রয়ে গেছি। বরং বলা যায়, দিন দিন বেদখল হওয়া জমির পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
রেলওয়ের সম্পত্তি মানে রাষ্ট্রের তথা জনগণের সম্পত্তি। যারা জনগণের সম্পত্তি গ্রাস করে, তারা রাষ্ট্র ও জনগণের শত্রু। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই দেশে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি গ্রাসের এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। আরো বেশি দুঃখজনক যে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা যান এবং থাকেন, তাঁরা রাষ্ট্রের শত্রুদের প্রতি বড় বেশি দুর্বল থাকেন এবং অজানা কারণে প্রীতও থাকেন। তাই রাষ্ট্রের শত্রুরা জনগণের সম্পত্তি হরণ করেও সমাজে বেশ বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান। ভিআইপির মর্যাদা পান। তাঁদের গ্রাস থেকে রেলওয়ের সম্পত্তি উদ্ধার করাটা খুব সহজ কাজ নয়। তার পরও সাবেক রেলমন্ত্রীর কথায় আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর আশ্বস্ত থাকতে পারিনি। তাই বর্তমান রেলমন্ত্রীর কথায় আমরা কতটুকু আশ্বস্ত হব তা এখনো বুঝতে পারছি না।
তিনটি বাজেটের অর্থের জোগান দেওয়া হোক বা না হোক, রাষ্ট্রের এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি যে অবৈধ দখলে রয়েছে, এই সত্যটি অন্তত আগের এক রেলমন্ত্রীর বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে। কয়েক বছর আগের এক হিসাবে জেনেছিলাম, কেবল পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়েরই সাত হাজার একরের বেশি জমি অবৈধভাবে দখলদাররা গ্রাস করেছে। যেসব স্থানে রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে, সেসব স্থানে এই দখল আরো দ্রুত গতি পেয়েছে। এই দখলের পেছনে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রভাবশালী 'রাজনৈতিক ব্যক্তি' ও সুযোগসন্ধানীরা। আবার এমন কিছু 'অতিচালাক' ব্যক্তি রয়েছেন এই সমাজে, যাঁরা নিজেদের দখলকে 'হালাল' ও নিরঙ্কুশ করার জন্য দখলকৃত ভূমির একটি অংশে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, জানাজা পড়ার স্থান ইত্যাদি ধর্মসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তাঁরা ভালো করেই জানেন, মসজিদ উচ্ছেদ করার সাহস কেউ পাবে না, কারণ তা করলেই জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এবং মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। আর এই সুযোগে বাকি অবৈধ সম্পত্তি ভোগ করতে তাদের কোনো অসুবিধাই হবে না। খোদ ঢাকা শহরেই রেলওয়ের এ রকম অনেক জমি পাওয়া যাবে। কিন্তু সামাজিকভাবে আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? তিনটি বাজেটের সমান মূল্যের রাষ্ট্রীয় সম্পদ কিছুসংখ্যক দুর্বৃত্ত লুটেপুটে খাবে- এটা কি করে সম্ভব!
সঠিক উদ্যোগ নিলে কিছু না কিছু হয়ই। নিকট অতীতেও আমরা তার কিছু প্রমাণ পেয়েছি। রেলমন্ত্রীর কথায় সম্ভবত আমরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারি। কিন্তু আবারও বলছি, উদ্যোগটি হতে হবে সঠিক ও আন্তরিক। নিজের লোক, নিজ দলের 'ব্যাকিং' বা অন্য কিছু দেখলে সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না। অতীতেও হয়নি। দেখতে হবে রেলের জমি। সেটা যার দখলেই থাকুক, রেলওয়ের মালিকানায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর তা করা গেলে দেশের মানুষ অবশ্যই রেলমন্ত্রী তথা সরকারকে সাধুবাদ জানাবে।
পাশাপাশি রেলওয়েকে সচল করার জন্যও চেষ্টা চালাতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রেললাইন ক্রমশ ট্রেন চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক লাইনে ঠিকমতো স্লিপার ও পাথর নেই। স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশের খাদ্যগুদাম বা সাইলোগুলোতে রেল যোগাযোগ ছিল, সেই রেল যোগাযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে প্রায় পৌনে তিন শ কিলোমিটার রেলপথ বন্ধ হয়েছে। আশির দশকে বন্ধ হয়েছিল নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নরসিংদী-মদনগঞ্জ রুট। নব্বইয়ের দশকে পূর্বাঞ্চলের ফেনী-বিলোনিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ-শাল্লা, হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ; পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট-মোগলহাট, রূপসা-বাগেরহাট, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া, ভেড়ামারা-রায়টা ও পাঁচুরিয়া-পুকুরিয়া পথে রেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর কেবল সিরাজগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ তৈরি করা হয়েছে।
১৮৭০ সালে ব্রিটিশরা এ দেশেও কিছু রেল কারখানা বানিয়েছিল, যেগুলোতে তখন রেলগাড়ির ইঞ্জিনও তৈরি হতো। স্বাধীনতার আগে তো বটেই, স্বাধীনতার পরও কিছুদিন পর্যন্ত এ দেশের রেলওয়ে কারখানায় বগি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষদিকে স্থানীয়ভাবে বগি তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকিস্তান থেকে প্রচুর বগি আমদানি করা হয়। ১৯৬৭-৬৮ অর্থবছরে এখানে ২৬৪টি বগি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তাহলে এখন কেন আমরা বগি বানাতে পারব না? বর্তমানে বিদেশ থেকে একটি বগি আমদানিতে খরচ হয় প্রায় চার কোটি টাকা। অথচ রেলওয়ের সূত্র মতে, সৈয়দপুর ওয়ার্কশপে মাত্র ৮০ লাখ টাকায় বগি নির্মাণ করা সম্ভব। পাশাপাশি এখানে বগি তৈরি হলে দেশের বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানাটি যথেষ্ট আধুনিক একটি কারখানা। বলা যায়, এই কারখানাটির বদৌলতেই এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনগুলো কোনোরকমে চালু রাখা সম্ভব হয়েছে। এখানে যে ধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা রয়েছে, তাতে কেবল যন্ত্রাংশ আমদানি করে নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করাও সম্ভব। তাতে খরচও অনেক কম পড়ত। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সরকারই সে উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি ছাতকের কংক্রিট স্লিপার ফ্যাক্টরিতেও উপযুক্ত পরিমাণে স্লিপার বানানো হচ্ছে না। মাসে প্রায় ৫০ হাজার স্লিপার তৈরির ক্ষমতা থাকলেও এখানে তিন-চার হাজারের বেশি স্লিপার তৈরি হয় না। অথচ বিদেশ থেকে স্লিপার আমদানি করা হয়।
১৯৬৯-৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি, আর ২০০০-২০০১ সালে ছিল ২৭৭টি, যার মধ্যে ১৫৫টি ইঞ্জিনেরই বয়স ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। সাধারণত একটি ইঞ্জিনের ইকোনমিক লাইফ বা অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। একইভাবে কমেছে বগির সংখ্যাও। কমেছে রেলকর্মী ও স্টেশনের সংখ্যা। ১৯৬৯-৭০ সালে রেলে কর্মকর্তা ছিল ২১০ জন এবং কর্মচারী ছিল ৫৫ হাজার ২০৩ জন। ২০০০-২০০১ সালে কর্মকর্তা বেড়ে হয়েছে ৫০৪ জন, কিন্তু কর্মচারীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৯৯ জনে। বর্তমান সরকার ১১ হাজার রেলকর্মী নিয়োগের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতেও রেলকে কার্যকর করার কিছুটা সদিচ্ছা দেখতে পাওয়া যায়।
বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিমাতাসুলভ আচরণ। স্বাধীনতার পরও যেখানে সড়ক ও রেলপথে বাজেট বরাদ্দ ছিল প্রায় সমান সমান, সেখানে ২০০২ থেকে শুরু করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যে বরাদ্দচিত্র পাওয়া যায়, তাতে রেলের অংশ ছিল মাত্র ১২ শতাংশ এবং সড়ক খাতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ শতাংশ। এসব কারণে রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন মেরামতের জন্য যে ছয়টি কারখানা রয়েছে, তার কোনোটিই সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। সময় সময় কিছু উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে চলে নানা রকম গড়িমসি, যেখানে আমলারা একটি বড় ভূমিকা পালন করেন। টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত দুই লাইন করার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০১১ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এ রকম বহু প্রকল্প প্রতিনিয়ত নেওয়া হচ্ছে এবং একসময় মারাও যাচ্ছে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। কেবল সংস্কারের অভাবে এ পথে এখন ট্রেন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। হেঁটে চলার মতো গতিতে ট্রেন চালাতে হয়। এতে সময় বেশি লাগে বলে যাত্রীরা ট্রেন ছেড়ে বাসমুখী হয়ে পড়েছেন। যে কয়টি ট্রেন চলাচল করে, সেগুলো একরকম ফাঁকাই আসা-যাওয়া করে। অথচ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-ভৈরব রেলপথ সংস্কার ও ডাবল লাইন করে প্রতি ঘণ্টায় ট্রেন চালানো হলে প্রচুর লোক এসব জায়গা থেকে ঢাকায় এসে অফিস করতে পারত। এতে ঢাকার ওপর জনসংখ্যা ও যানবাহনের যে চাপ, তাও অনেকটাই কমে যেত। আখাউড়া থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডাবল লাইন করার কাজও চলছে কচ্ছপগতিতে। গৌরীপুর-মোহনগঞ্জ, গৌরীপুর-জারিয়া-জাঞ্জাইল, সিলেট-ছাতক, চট্টগ্রাম-দোহাজারী, লালমনিরহাট-বুড়িমারী, তিস্তাঘাট-বামনাবাজার, লাকসাম-চাঁদপুর, রাজশাহী-রোহনপুর, আমনুরা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ কিংবা আরো কিছু রেলপথ আছে, যেগুলোতে ট্রেন চালানোটাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়তই ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। বাড়ছে যাত্রীদের দুর্ভোগ-দুর্ঘটনা। এদিকে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি নিয়েও চলছে নানা ধরনের তেলেসমাতি। জোট সরকারের আমলে যোগাযোগমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে রেলের জমি লিজ দেওয়া নিয়ে গণমাধ্যমে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছিল। এর আগেও বিভিন্ন সরকারের সময় এ অপকর্মটি বেশ ভালোভাবেই সম্পাদন করা হয়েছে। আমরা আশা করি, বর্তমান মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং শুধু কথায় নয়, কাজেও তার প্রমাণ দেবে।
১৩ আগস্ট ২০১২
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.