দুর্নীতির 'চমৎকার' নজির-জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক

জনগণের সম্পদ ও অর্থের এমন অপব্যবহার এবং লুটপাট বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত আগে আর কখনো ঘটেনি, যা বর্তমান সরকারের আমলে আমরা ঘটতে দেখছি। আর এ ক্ষেত্রে একটি 'চমৎকার' নজির স্থাপন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।


নগর ভবনের দক্ষিণ পাশে 'ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২' নামে বিশাল আকৃতির তিনটি ভবন রয়েছে। সেখানে মাত্র ২০ টাকা বর্গফুট দরে এক লাখ ৩৬ হাজার বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে গত বছর প্রায় সাত কোটি টাকা নেওয়া হয়েছিল প্রতি বর্গফুট সাড়ে চার হাজার টাকা দরে। আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে, সেই জায়গা ডিএসসিসির একটি চক্র কিভাবে ২০ টাকা বর্গফুট দরে বরাদ্দ দিয়ে দেয়! ধারণা করা হচ্ছে, এই বরাদ্দ দেওয়ার মাধ্যমে প্রায় ৬০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। কারা এই অর্থ নিয়েছে? ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট লোকজনের মতে, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী-এমপিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেরও কেউ কেউ এতে জড়িত আছেন। হায়রে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা! এই গণতন্ত্র আর এই সুশাসনের জন্যই কি এ দেশের মানুষকে এত রক্ত দিতে হয়েছে?
২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রথম দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ছিল ক্ষমতায়। সে সময় বিরোধী দলে থাকা বিএনপি তখন সেই সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছিল এবং দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলেও দুর্নীতি কমেনি। বরং পর পর পাঁচ বছর ধরে আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নই থেকে গেলাম। ষষ্ঠ বছরেও দুর্নীতিতে আমাদের প্রাপ্ত নম্বর একই ছিল, কিন্তু আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ আরো বেশি নম্বর পেয়ে আমাদের টপকে গিয়েছিল। এরপর দেশে এসেছিল দুই বছর মেয়াদি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকারের শেষ বছরে বাংলাদেশের কপাল থেকে চ্যাম্পিয়নের কলঙ্কতিলক অনেকটা নিচে নেমে গিয়েছিল। নিচের দিকে ১৪তম স্থানে চলে এসেছিল বাংলাদেশ। সেই সময় বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) চেয়ারপারসন ড. হিউগেট লেবেল। তিনি তৎকালীন সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এ সাফল্যকে ধরে রাখার জন্য অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোর সংস্কার করতে হবে এবং তাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু তা কি আমরা করতে পেরেছি? দুর্নীতি দমন কমিশনকে কি আমরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে পেরেছি? দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য আমরা কি যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিতে পেরেছি? পারিনি। পারিনি বলেই আজ ডিএসসিসির মতো অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে অবাধে চুরি-ডাকাতি সবই চলছে। কে জানে, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের শেষ বছরে আবারও আমাদের কপালে চ্যাম্পিয়নের সেই কলঙ্কতিলক আঁকা হয়ে যায় কি না।
নিকট-অতীতে প্রশাসনের যেভাবে নির্বিচারে দলীয়করণ করা হয়েছে, তাতে প্রশাসনের যেমন দক্ষতা কমেছে, তেমনি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব আরো প্রকট হয়েছে। এটিও দুর্নীতির অন্যতম কারণ। আমরা জানি, প্রশাসনের ওপরের দিকে যখন দুর্নীতি হয়, তখন নিচের দিকে তা আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই এই দলীয়করণ থেকে প্রশাসনকে মুক্ত করা না গেলে আমরাও দুর্নীতির রাহুমুক্ত হব না। বিচার বিভাগের পৃথক্করণের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ায় অনেক কিছুই বাকি রয়েছে। দক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা দুর্নীতি কমাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। একইভাবে পুলিশি ব্যবস্থা, তদন্ত, আইনি প্রক্রিয়া ইত্যাদি জোরদার করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বর্তমান সরকারের যদি সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তাহলে ডিএসসিসির ঘটনাটি ধরেই দেশবাসীর কাছে সেই সদিচ্ছার প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার তা করবে।

No comments

Powered by Blogger.