কোথায় সমাহিত হবেন হুমায়ূন

সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আজ আবার মা-মাটির কোলে ফিরছেন হুমায়ূন আহমেদ। কোটি ভক্তের প্রত্যাশা মিটিয়ে ব্যাধিকে জয় করে নয়, ফিরছেন কফিনবন্দি হয়ে। বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র, কিংবদন্তি এই লেখক-নির্মাতাকে শেষ বিদায় জানাতে উন্মুখ অপেক্ষায় রয়েছে অগণিত ভক্ত-অনুরাগীসহ সর্বস্তরের মানুষ।


বিমানের সময়সূচি ঠিক থাকলে আজ সোমবার সকাল পৌনে ৯টায় তাঁর মরদেহ নিয়ে স্বজনদের দেশে পৌঁছার কথা।
দেশবরেণ্য কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় সমাহিত করা হবে- এ নিয়ে গতকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে এ নিয়ে। এর আগে নুহাশপল্লীতে দাফনের কথা জানানো হলেও এখন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, বনানী কবরস্থান কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কবর দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর স্বজনদের বহনকারী এমিরেটস এয়ারলাইনসের বাংলাদেশ অভিমুখী ফ্লাইট রাতে দুবাইয়ে যাত্রাবিরতি করলে শাওনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হতে পারে। না হলে তিনি ফেরার পর তাঁর মতামত নিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে বলে পারিবারিক সূত্র জানায়।
গত রাত সাড়ে ১১টার দিকে হুমায়ূন আহমেদের মামা মাহবুবুন্নবী শেখ কালের কণ্ঠকে জানান, শাওনের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। যোগাযোগ করার চেষ্টা চলছে। সম্ভব না হলে ফেরার পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানা গেছে, প্রয়াত লেখকের অনুজ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল গতকাল দেশে ফেরার পর এক পারিবারিক বৈঠকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দাফনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। মিরপুরের পল্লবীতে হুমায়ূনের ছোট ভাই আহসান হাবীবের বাসায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বৈঠকের পর আহসান হাবীব সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তবে নুহাশপল্লীতে তাঁর দাফন হচ্ছে না। ভক্ত আর শুভানুধ্যায়ীরা চাইছেন, তিনি যেন সবার মাঝে থাকতে পারেন। তাই আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।'
এর আগে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু-পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মঙ্গলবার বাদ জোহর গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদকে সমাহিত করা হবে। হুমায়ূন আহমেদও একসময় নুহাশপল্লীতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এর পরই একটি বার্তা সংস্থায় প্রকাশিত তাঁর এক সাক্ষাৎকারে অন্য মনোভাবের কথা জানা যায়। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমি চাইছিলাম, আমার মৃত্যুর পর কবরটা এখানে (নুহাশপল্লী) হোক। পরে দেখলাম, এটা কবরস্থান হয়ে যাবে। এটা কবরস্থান হওয়ার স্থান নয়। এটা তখন গুলিস্তানে পরিণত হবে। এখানে দুনিয়ার লোক আসবে। একুশে ফেব্রুয়ারি ফুল দেওয়ার জন্য, ১৩ নভেম্বর ফুল দেওয়ার জন্য আসবে। এটা হয়ে যাবে একটা কবরস্থান। এটা কবরস্থান বানানো যাবে না।'
হুমায়ূন আহমেদকে নুহাশপল্লীর পরিবর্তে ঢাকার কোনো কবরস্থানে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আজ সোমবার বিকেলেই করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। কিন্তু নুহাশপল্লীতে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত হলে সেটা পরের দিন হতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশ সময় রবিবার সকাল ৯টায় নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর থেকে এই প্রয়াত কথাশিল্পীর মরদেহ নিয়ে দেশের উদ্দেশে রওনা হন স্বজনরা। সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী শাওন, শাশুড়ি তহুরা আলী এমপি, দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত, শ্যালিকা সেঁজুতি এম আফরোজ ও অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম। সোমবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে তাঁদের ঢাকায় পৌঁছানোর কথা।
হুমায়ূন আহমেদকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে জেএফকে বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক শ প্রবাসী বাংলাদেশি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেনও উপস্থিত হয়ে ওই মিশনের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত লেখককে শেষ বিদায় জানান।
প্রিয় লেখকের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। এরপর দুপুর আড়াইটায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের প্রহর কাটছে না বড় ছেলের অপেক্ষায়। শয্যাশায়ী মা ছটফট করছেন ছেলের মুখ দেখার জন্য। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছোট ছেলে আহসান হাবীবের পল্লবীর বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায় মাতম চলছে। আহসান হাবীব জানিয়েছেন, হুমায়ূন আহমেদকে গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে দাফন করা হলে সেখানেই বাকি জীবন কাটাবেন মা আয়েশা ফয়েজ। নিজের এ ইচ্ছার কথা ছোট ছেলেকে জানিয়েছেন তিনি। তার আগে ছেলের মুখ শেষবারের মতো দেখার অপেক্ষা করছেন তিনি। সবাই তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
১০ মাস ক্যান্সারে ভোগার পর গত ১৯ জুলাই রাতে নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হুমায়ূন আহমেদ।
'ক্যান্সারে নয়, ভাইরাসে মৃত্যু'
ক্যান্সারে নয়, ভাইরাস সংক্রমণে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হওয়ার কথা জানিয়েছেন লেখকের ছোট ভাই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। নিউ ইয়র্ক থেকে রবিবার সকালে ঢাকায় ফিরেছেন তিনি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ক্যান্সার আক্রান্ত হলেও এ রোগে মারা যাননি ভাই হুমায়ূন আহমেদ। ভাইরাস সংক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রোপচারের পর হুমায়ূন আহমেদের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, যা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
নিউ ইয়র্ক থেকে জাফর ইকবাল ঢাকায় ফিরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর পল্লবীতে ছোট ভাই আহসান হাবীবের বাসায় যান। সেখানে অবস্থান করছেন মা আয়েশা ফয়েজ। বাড়িতে ঢুকেই মায়ের কক্ষে যান তিনি। জাফর ইকবালকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। এ সময় সেখানে ছিলেন তাঁর ছোট ভাই আহসান হাবীব, তিন বোন সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ, রুখসানা আহমেদ, ভাগ্নে-ভাগ্নিসহ নিকটাত্মীয়রা।

No comments

Powered by Blogger.