পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই-প্রিয় তিন কন্যাকে নিয়ে শেষ জীবনে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণ by মোরসালিন মিজান

কী তিনি পাননি! আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ছিল। খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিলেন। তাই যেখানে গেছেন সেখানেই অন্য সব আলো নিভে গেছে। একমাত্র আলোটি হয়ে জ্বলেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গত কারণেই শেষ জীবনে তাঁর মনে কোন ব্যথা ছিল, এমনটি অনেকেই ভাবতে যাবেন না।


কিন্তু খুব সূক্ষ্ম একটি বেদনার বোধ হুমায়ূন আহমেদের মনে সত্যিই ছিল। আর তা হচ্ছেÑ প্রিয় তিন কন্যাকে কাছে না পাওয়ার বেদনা। শত হাসিখুশির মাঝেও কন্যাদের ভীষণ মিস করতেন তিনি। নোভা, শিলা ও বিপাশাকে কাছে না পাওয়ার ব্যথায় বার বার নীল হয়েছেন। লেখকের বহু লেখা পড়ে এমন ধারণা পাওয়া যায়।
জানা যায়, অত্যন্ত স্নেহের তিন কন্যাকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতেন হুমায়ূন আহমেদ। মেয়েরাও বাবা ছাড়া একটি মুহূর্ত কাটানোর কথা চিন্তা করতে পারত না। এভাবেই বেড়ে ওঠে তারা। কিন্তু হুমায়ূনের দ্বিতীয় সংসার অনেক কিছুই এলোমেলো করে দেয়। ২০০৫ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদ হয় হুমায়ূন আহমেদের। একই সময় বাবার সঙ্গে সব রকমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তিন কন্যার। লম্বা সময় পর পুত্র নুহাশকে কাছে পেলেও মেয়েদের সঙ্গে দেখাটুকুও হতো না। সর্বশেষ হুমায়ূন আহমেদের শরীরে যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে তখনও দুই পক্ষের অভিমানই হয়েছিল বড় সত্য। কোন পক্ষই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, উভয় পক্ষ একে অন্যকে গভীরভাবে মনে রেখেছে। মেয়েরা প্রতি মুহূর্তে বাবার কথা ভাবতেন। বাবাও প্রতি মুহূর্তে মেয়েদের কথা ভেবে আবেগাপ্লুত হতেন। মেয়েদের কাছে না পওয়ায় সূক্ষ্ম এক বেদনার বোধ ছিল পিতার মনে। মেয়েদের তা তিনি কখনও বুঝতে দেননি। তবে মাঝে মধ্যেই তাঁদের কথা লিখেছেন। বিশেষ করে শেষ দিনগুলোতে তিনি মেয়েদের স্মৃতিচারণ করে কাটিয়েছেন। নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় লেখা একাধিক বইতে সে বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি বইয়ে তিনি আলাদা আলাদাভাবে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন তিন কন্যার। স্বভাবসুলভ সহজ বর্ণনা দিয়েছেন। শুরু করেছেন বড় নোভাকে দিয়ে। বাবা হুমায়ূন লিখেছেনÑ নোভা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছে। আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে বর্তমানে দেশে ফিরেছে। আমি যখন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছি তখনকার কথা। ইউনিভার্সিটি আমাকে বাগান করার জন্য দুই কাঠা জমি দিয়েছে। আমি মহা উৎসবে শাইখ সিরাজ হয়ে গেলাম। খুন্তি, খুরপাই, কোদাল কিনে এক হুলস্থূল কা-। মহা উৎসাহে জমি কোপাই, পানি দেই। বীজ বুনি। আমার সর্বক্ষণিক সঙ্গী কন্যা নোভা। বিকাল পাঁচটায় ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখি, বাড়ির সামনে খুরপাই ও কোদাল নিয়ে নোভা বসে আছে। প্রথমে জমিতে যেতে হবে, তারপর বাসায় ঢোকা। যেদিন ফসলে জমি ভরে গেল সেদিনের দৃশ্য মেয়ে গাছ থেকে ছিঁড়ে টলটলে লাল টমেটো প্লাস্টিকের বালতিতে ভরছে এবং বলছে ড্যাডি আই মেড ইট! স্মৃতি রোমন্থন করে লেখক বলেন, মেয়ে তখনও বাংলা বলা শেখেনি। তাঁর আনন্দ দেখে চোখ মুছি আমি।
হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় কন্যা বেশ বিখ্যাত। হ্যাঁ, শীলা। বাবা ভীষণ ভালবাসতেন এই মেয়েকে। তাঁর সম্পর্কে সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ জানিয়ে বাবা যা লেখেন তা এরকমÑ শিলা। শুরুতে ছিল শীলা আহমেদ। স্বামী এসে স্ত্রীর নামের শেষে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বাবাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দেয়। এর পর সেই বিচ্ছিন্নতার গল্প। খুব সাবলীলভাবেই হুমায়ূন লেখেনÑ এখন শীলার নামের অবস্থা কি জানি না। এই মেয়েটিও বড় বোনের মতো মেধাবী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স ও এমএ-তে ইকোনমিক্সে প্রথম শ্রেণী পেয়েছে।
এরপর শিলার বাকি গল্প বলেন তিনি। লেখক জানান, তখন শীলার বয়স বারো কিংবা তেরো। সবাইকে নিয়ে লসএনজেলস গিয়েছেন তিনি। হোটেলে ওঠার সামর্থ্য নেই। বন্ধু ফজলুল আলমের বাসায় উঠেছেন। লেখকের ভাষায়Ñ আমি ক্যাম্পিং পছন্দ করি ফজলু জানে। সে বনে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করল। আমরা জঙ্গলে এক রাত কাটাতে গেলাম। প্রচ- শীত পড়েছে। তাঁবুর ভেতর জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছি। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। দেখি, শীলা বসে আছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, মা, কি হয়েছে? শিলা জানায়, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে, সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। আমি বুঝলাম, এই মেয়ের কঠিন ক্লস্টোফোবিয়া। আসলেই সে নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। আমি বললাম, গরম কাপড় পরো। তাঁবুর বাইরে বসে থাকব। সে বলল, একা একা থাকতে পারব না। ভয় লাগে। কিছুক্ষণ একা থাকতে গিয়েছিলাম। আমি বললাম, আমি সারা রাত তোমার পাশে থাকব। লেখক জানান, তিনি তা-ই করেন। লেখেনÑ মেয়ে এক পর্যায়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাল। সকাল হলো। মেয়ের ঘুম ভাঙল। সে বলল, বাবা, তুমি একজন ভাল মানুষ। হুমায়ূন লিখছেনÑ আমি বললাম, মা! পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই। এর পরের লেখাগুলো এক কথায় অদ্ভুত। লেখক সবটুকু রহস্য নিজের মধ্যে ধরে রেখে তাঁর পাঠকদের জানাচ্ছেনÑ এখন মনে হয় শীলা বুঝে গেছে, পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে। যেমন, তার বাবা।

হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় কন্যার নাম বিপাশা। এ মেয়ে সম্পর্কে একই বইয়ে তিনি লিখেছেনÑ বিপাশা অন্যসব ভাইবোনের মতোই মেধাবী। ব্রাকেটে তাঁর রসিকতাÑ বাবার জিন কি পেয়েছে? হা হা হা। আমাকে পছন্দ না হলেও আমার জীবন কিন্তু মেয়েকে আজীবন বহন করতে হবে। অর্থাৎ মেয়ে বিপাশার অপছন্দের কথাও অকপটে বলছেন লেখক। পরের বর্ণনায় দীর্ঘশ্বাস। মেয়ের সঙ্গে বহু বছর বিচ্ছিন্ন বাবা লেখেনÑ এই মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে অনার্স এবং এমএতে প্রথম শ্রেণী পেয়ে আমেরিকায় কী যেন পড়ছে। আমি জানি না। পরবর্তী অংশে তাঁর প্রতি মেয়ের ভালবাসার একটি উদাহরণ টানেন তিনি। লেখেনÑ আমার ধারণা, এই মেয়েটি অসম্ভব রূপবতী বলেই খানিকটা বোকা। তার বালিকা বয়সে আমি যখন বাইরে কোথাও যেতাম, সে আমার সঙ্গে একটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি দিয়ে দিত। এ শিশিতে নাকি তার গায়ের গন্ধ সে ঘষে ঘষে ঢুকিয়েছে। তার গায়ের গন্ধ ছাড়া আমি ঘুমুতে পারি না বলেই এই ব্যবস্থা। যেদিন আমি আমেরিকা রওনা হব, সেদিনই সে আমেরিকা থেকে তিন মাসের জন্য দেশে এসেছে। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। একবার ভাবলাম বলি, মা, অনেক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। ফিরব কি-না তাও জানি না। এক শিশি গায়ের গন্ধ দিয়ে দাও। কিন্তু আক্ষেপের সঙ্গে লেখক জানানÑ বলা হলো না।
এ পর্যায়ে কিছুটা খোলামেলা হবার চেষ্টা যেন। ক্যান্সার আক্রান্ত হুমায়ূন দুঃখ করে লেখেনÑ আমার তিন কন্যাই দূরদ্বীপবাসিনী। ওরা এখন আমাকে চেনে না, হয়ত আমিও তাদের চিনি না। কী আর করা? কে সারা সারা!
তবে এত বিচ্ছিন্নতার মাঝেও একটি দুটি ব্যতিক্রম ঘটেছে বলে লেখক জানিয়েছেন। তেমন একটি ঘটনার বর্ণনা করে তিনি লেখেনÑ আমার এখন চার নাতি-নাতনি। আমি যেখানে বাস করি তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ বলে এদের আমি দেখি না। ওরাও গ্রান্ড পা ডাকার সুযোগ পায় না। আমার কর্কট রোগের সিলভার লাইনিং হলো, এ রোগের কারণে প্রথমবারের মতো আমার তিন কন্যা আমাকে দেখতে তাদের সন্তানদের নিয়ে ‘দখিন হাওয়া’য় পা দিল। ঘরে ঢুকল তা বলা যাবে না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। সূর্যের চেয়ে বালি গরম হয়Ñ এই আপ্তবাক্য সত্য প্রমাণ করার জন্য মেয়েদের স্বামীরা মুখ যতটা শক্ত করে রাখার ততটা শক্ত করে রাখল। অবশ্যি হুমায়ূন আহমেদ নিজেও সেই অর্থে তাদের দিকে ফিরে তাকালেন না। এমন কথা শুনে মনে হতে পারে, হুমায়ূনেরও জেদ কম ছিল না। কিন্তু আসলে তা নয়। আসলে তিনি বাবা। সেই বাবা হুমায়ূন মেয়েদের দিকে না তাকানোর কারণ ব্যাখ্যা করে লেখেনÑ ঘরভর্তি মানুষ। মেয়েদের দেখে হঠাৎ যদি আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করে কেঁদে ফেলি, সেটা ভাল দেখাবে না। হুমায়ূনের দেয়া তথ্যমতে, এ সফরের বাইরে ছোট মেয়ে বিপাশা আলাদা করে একবার বাবাকে দেখতে যায়। সে কি আনন্দ বাবার! আকস্মিক এ ঘটনায় অভিভূত বাবা সে কথা জানিয়ে এক জায়গায় লেখেনÑ ফেব্রুয়ারি মাসের এক রাতে আমার জ্যামাইকার অস্থায়ী নিবাসে অতি রূপবতী এক তরুণী ঘরে ঢুকে বলল, বাবা, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। তুমি কি ভাল আছ? হুমায়ূন বলেনÑ অবাক হয়ে দেখি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশা স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে আরাকানসাস থেকে এসেছে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে।
ক্যান্সার আক্রান্ত হুমায়ূনের শেষ জীবনের ভাবনায় খুঁজে পাওয়া যায় প্রথম প্রেম গুলতেকিনকেও। এ স্ত্রীর বেলায়ও একই রকম বর্ণনা। সব অপরাধ বিনাবাক্যে নিজের গায়ে নিয়েছেন লেখক। এর বাইরে কিছু ছিল কি-না কাউকে তা জানতে দেননি। শুধু পেছনের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। কেন? তবে কি হুমায়ূন জেনে গিয়েছিলেন, সেই সব দিন আর কোন দিন ফিরে আসবে না তাঁর জীবনে!

No comments

Powered by Blogger.