শ্রদ্ধাঞ্জলি-হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে by মাসুক হেলাল

বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা তখন অনেকেই নীহার, নিমাই, ফাল্গুনী ছাপাচ্ছেন। নসাসের (নওরোজ সাহিত্য সংসদ) ইফতেখার রসুল জর্জের দোকানে হুমায়ূন ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকবার যাওয়া-আসার পর জর্জদা হুমায়ূন আহমেদের বই ছাপাতে রাজি হলেন।


তারও সাত-আট বছর আগে হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে খান ব্রাদার্স থেকে বের হয়। সাপ্তাহিক রোববার-এ সৌরভ বলে একটা উপন্যাস বেরিয়েছে। তাঁর হাতে বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি। অথচ কোনো প্রকাশক বই বের করতে রাজি হচ্ছেন না। চা খাওয়ান, নানা কথা বলেন, কিন্তু কেউ বই ছাপাতে রাজি হন না। মাঝেমধ্যে আমি ও হুমায়ূন ভাই বাংলাবাজার যাই। জর্জদা কথা দিলেও হুমায়ূন ভাইয়ের বই ছাপছেন না। তিনি সত্যজিৎ রায়ের বই ছাপা নিয়ে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে দেখা হয়। মিলন ভাইও লড়াই করছেন। একদিন মিলন ভাই জর্জদাকে বললেন, ‘জর্জদা, দেইখেন, আমি আর হুমায়ূন ভাই এ বাংলাবাজার থাইক্যা দাদাগো খেদামু। তখন আমরাই রাজত্ব করুম।’
জর্জদা এক-দেড় বছর পর হুমায়ূন ভাইয়ের বই ছাপলেন। বইয়ের নাম অরণ্য। কভারটা আমার আঁকা ছিল। তার পরও মাঝেমধ্যে বাংলাবাজার যাই। দুপুরে বিউটি বোর্ডিংয়ে খাই; কখনো সদরঘাটের লঞ্চের ভাসমান ‘হিন্দু হোটেলে’ ভাত খাই। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় ঘুরি। আমি রাতে সদরঘাট ও কমলাপুর স্টেশনে ছবি আঁকতে যেতাম। সঙ্গে হুমায়ূন ভাই। ছবি আঁকি। হুমায়ূন ভাই ঘুরে ঘুরে ঘুমন্ত মানুষ দেখেন। ভোর রাতের দিকে দুজনে হলে ফিরি। একবার রাতে হাইকোর্টের সামনে একদল মাতাল হাইজ্যাকার আমাদের ছুরি দেখিয়ে ঈদগাহের ভেতর ঘণ্টা দুয়েক আটকে রাখে। সেটা নিয়ে হুমায়ূন উপন্যাস লেখেন—চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক।
২.
কিছুদিন পরের কথা। ইতিমধ্যে হুমায়ূন ভাই টিভিতে কিছু সফল নাটক লিখে ফেলেছেন। দেশজুড়ে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। আমি সাপ্তাহিক বিচিত্রার আর্টিস্ট। মাঝেমধ্যে হুমায়ূন ভাই বিচিত্রায় আসেন, সেখান থেকে বিটিভিতে যাই। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরি। বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় তখন নিয়মিত উপন্যাস লিখছেন হুমায়ূন ভাই। বিচিত্রা থেকে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হতো হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে উপন্যাস আদায় করার। একবার আনন্দ বিচিত্রা হুমায়ূন ভাইয়ের ওপর কী একটা খবর ছাপে। এতে হুমায়ূন ভাই খুব খেপে যান। তিনি ঠিক করেন, বিচিত্রায় আর উপন্যাস লিখবেন না।
নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির আমাকে দায়িত্ব দেন, যে করে হোক হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে উপন্যাস আদায় করতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের বাসা শহীদুল্লাহ হলে গেলাম। আমাকে দেখে খেপে গেলেন হুমায়ূন ভাই। ‘তোমাদের বিচিত্রায় আমি লিখব না।’ আমি বসে থাকি চুপচাপ। একপর্যায়ে তাঁর রাগ কমে। নিজেই বলেন, ‘বিচিত্রায় ঈদসংখ্যা বেরোবে, আর আমার লেখা থাকবে না, তা হয় না।’ তিনি হাঁটুমুড়ে চেয়ারের ওপর কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করলেন। সারা রাত লিখলেন। একটা একটা করে পাতা তিনি লিখছেন, আমি পড়ছি। সেটাই মিসির আলির প্রথম কাহিনি। বিচিত্রায় আমিই উপন্যাসটির ইলাস্ট্রেশন করেছিলাম।
৩.
হুমায়ূন ভাই তখন মাটিতে বসে টি-টেবিলের ওপর কাগজ রেখে লিখতে বসতেন, মাটিতে প্লেটে কিছু ভাত থাকত। সঙ্গে একটা কাঁচি। লেখা ভুল হলে সে অংশ কেটে তার ওপর ভাতের আঠা দিয়ে সাদা কাগজ সেঁটে দিতেন। তার ওপর আবার লিখতেন। আমি একবার তাঁর এ অবস্থা দেখে একটা পেলি গাম কিনে দিয়ে আসি। কয়েক দিন পর হুমায়ূন ভাই গামটা নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে আসেন। ‘নেও মিয়া, তোমার গাম। এইটা দিয়ে আমার কাম হয় না। আমার ভাতই ভালো।’
৪.
হুমায়ূন ভাই লিখতে বসলে একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন। চায়ের কাপে ঘনঘন চুমুক দিচ্ছেন। ছোট ছোট অক্ষরে লিখে চলেছেন। বিড়বিড় করে কথা বলছেন। হঠাৎ হয়তো লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন। লুঙ্গিটা কোমরের কাছে বাঁ হাত দিয়ে ধরে রাখতেন। ঘরময় হাঁটতেন। তখনো যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছেন। কেউ এ সময় কথা বললে একটু তোতলা হয়ে যেতেন। দ্রুত কথা বলতেন।
৫.
চাঁদপুরে আগুনের পরশমণির শুটিং হবে। ‘অঙ্গীকার’ ভাস্কর্যের ছবি নেওয়া হবে। এটি হবে ছবির টাইটেল শট। একটি দোতলা লঞ্চ ভাড়া করা হলো। ইউনিটের সঙ্গে রয়েছে একদল গান-বাজনার লোক। চাঁদনি রাতজুড়ে লঞ্চের ছাদে গান-বাজনা ও খাওয়া-দাওয়া হলো। হুমায়ূন ভাই চাঁদ দেখতে শুয়ে আছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেলিম চৌধুরী গাইছেন হাসন রাজার গান। আমি চোখ বুজলে এখনো এই দৃশ্য দেখতে পাই।
৬.
আহমদ ছফা একবার পদ্মা নদীতে নৌকায় চড়ে বৃষ্টি দেখাতে নিয়ে গেলেন। হুমায়ূন ভাই, ছফা ভাই, তাঁর জার্মান বান্ধবী মেরি ও আমি মাওয়া ফেরিঘাট থেকে পাল তোলা ডিঙি নৌকা ভাড়া করি। পদ্মা নদীতে ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা চলছে। হঠাৎই কালো হয়ে এল আকাশ! মাঝ নদীর নৌকাগুলো নদীর পাশ ঘেঁষে ধঞ্চে বনে ঢুকে গেল! শিগগিরই আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি। ঠান্ডায় কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা কাঁপতে শুরু করলাম। বৃষ্টির মধ্যে নদীর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হুমায়ূন ভাই মৃদু স্বরে বলছিলেন, ‘কী সাংঘাতিক, কী সাংঘাতিক!’
মাসুক হেলাল

No comments

Powered by Blogger.