নত মাথা নয় পরাভব নয় by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। জীবন-মৃত্যুর দরোজার ওপাশে তিনি এখন অচেনা অজানা ভুবনের বাসিন্দা। জীবিতকালেই তিনি কিংবদন্তি হয়েছিলেন। বাংলাভাষা পড়ুয়াদের কাছে তিনি ছিলেন প্রবাদপুরুষ। গ্রন্থপাঠে যাদের অভ্যস্ততা নেই তারা মুগ্ধ ছিলেন হুমায়ূনের টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্র দর্শনে।


মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তিনি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মন। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের বিস্তার ঘটেছে হুমায়ূন আহমেদের একক দাপটে। হুমায়ূনের এই দাপট থাকবে আরও অনেক দিন, এটা বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। হুমায়ূন রচিত অসংখ্য গ্রন্থের ভেতর বেশ কটি গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধনির্ভর। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ অফিসার পিতা নিহত হয়েছেন। সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিদস্যু এবং রাজাকারদের হাতে। রাজাকারদের প্রতি তীব্র ঘৃণা তাই তিনি বয়েছেন আমৃত্যু। আশির দশকে সবদিক থেকে আবদ্ধ দেশে দর্শকপ্রিয় টেলিভিশন নাটকে তিনি সেই ঘৃণার প্রকাশও ঘটিয়েছেন চাতুর্যের সাথে। আবারও বলি, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে দেশের তরুণ সমাজকে বিনি সুতায় বাঁধবার ক্ষমতা হুমায়ূনের চেয়ে বেশি কার আছে! গত নির্বাচনে যে দেড় কোটির অধিক তরুণ ভোটার মুুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি রায় দিয়েছেন, আমার ধারণা তাদের ওপর হুমায়ূনের প্রভাব ছিল। এই প্রভাব হুমায়ূনের অনুপস্থিতিতেও আরও অনেকদিন থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। আগল ভাঙার কারিগর হুমায়ূন আহমেদ সম্ভাবনার বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন উজ্জ্বল আলোকিত সমাজের। কাজ করেছেন নতুন আঙ্গিকে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির। সফলও হয়েছেন। অকাল প্রয়াত এই শিল্প কারিগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং সেই সাথে এও বলি যে হুমায়ূন আহমেদের এপিটাফ লেখার জন্য আজ কলম ধরিনি। তবু তাঁর সম্পর্কে ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা আমি উল্লেখ করব এই জন্য যে, আমার আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গের সঙ্গে হয়ত কিছুটা হলেও সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ২০০১ সাল। জাতীয় নির্বাচনের খানিক আগেই শুরু হয়ে গেল গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নরমেধ যজ্ঞের উৎসব। চলল নির্বাচনপরবর্তী সময় পর্যন্ত। মানবতাবিরোধী অপকর্মের শিকার হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগের অসংখ্যা নেতাকর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সাধারণ জন। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধহীন সেই বীভৎসতায় বিচলিত হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম। দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বদের দিয়ে পত্রপত্রিকায় কলাম লেখাব। সেইসব কলামের বিষয়বস্তু হবে মানবতা, মুক্তিযুদ্ধের দর্শন, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সামাজিক শান্তি ইত্যাদি।
ছুটলাম অনেকের কাছে। কাজ হলো। কাজ হলোও না। মাত্র সপ্তাহখানেক আগে যে শ্রদ্ধাভাজন লেখক আওয়ামী লীগের পক্ষে কলম ধরেছেন। তাঁর তখন ভিন্ন সুর। কেউ কেউ বলেন, যা ঘটছে তা অনেকাংশেই রটনা। সব কথা সত্য নয়। হুমায়ূন আহমেদ তখন গাজীপুরের নুহাশ পল্লীতে। টেলিফোনে যোগাযোগ করে বেশ কষ্ট করেই নুহাশে পৌঁছলাম। নুহাশ পল্লীতে যেতে পিরুজালির রাস্তায় রিকশায় চেপে যেতে এখনও বেশ ধকল পোহাতে হয়। সব ঘটনা ও তথ্যসহ বিস্তারিত বলার পর হুমায়ূন আহমেদের ভাবলেশহীন চেহারা দেখে বেশ হতাশ হলাম। মন খারাপ করে নুহাশ পল্লীর গাছগাছালি আর পুকুর পাড় দিয়ে ঘুরেফিরে সময় কাটাচ্ছি। সিদ্ধান্ত, সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকার পথে রওনা দেব। আশাভঙ্গের হতাশায় মনটা তখন বিক্ষিপ্ত এবং নানা প্রশ্নে বিপর্যস্তও। ঠিক এই সময়ে হুমায়ূন হাতে দুটো কাগজের পৃষ্ঠা নিয়ে উপস্থিত। আমার দিকে কাগজগুলো বাড়িয়ে দিয়ে পড়তে বললেন। অতি সহজিয়া ভঙ্গিতে তাঁর সহজাত ভাষায় অসাধারণ একটি লেখা। মানবতা বিনষ্টকারীদের বিপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লেখাটি পড়ে অতিশয় মুগ্ধ এবং কৃতজ্ঞ হলাম। লেখাটি তিনি লোক মারফত ঢাকার একটি দৈনিকে নিজেই পাঠিয়ে দিলেন এবং পরদিন সেটা পত্রিকার প্রথম পাতায় গুরুত্বসহ ছাপাও হলো। আর আমি স্বস্তি পেলাম এই জন্য যে, ধর্মান্ধ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির নৃশংসতার বিরুদ্ধে যে সামান্য ক’জন শুভবাদী বিদগ্ধজন একত্রিত করে ভূমিকা রাখতে পারলাম তার ভেতর হুমায়ূন আহমেদের মতো নন্দিত ও জনপ্রিয় লেখকও অংশ নিলেন। গণমাধ্যমের এই সামান্য কাজকে সেদিন খুবই তৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে এই ধরনের কাজ এখনও করে চলেছি। নিজে লিখে এবং সমমনাদের দিয়ে লিখিয়ে। মানুষকে সচেতন করে জনমত তৈরির ক্ষেত্রে এই ধরনের কাজকে আমি দেশ, জাতি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ দায়িত্ব পালন হিসেবেও মনে করি। গত কয়েক বছর ধরে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, জাতীয় উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে এভাবেই তো কলম হাতে আমরা লড়ে চলেছি। তবে আমাদের বিরুদ্ধে রাজাকারপন্থী যে অশুভ শক্তি, তারা অনেক বেশি পরিকল্পনামাফিক চলে এবং দুই হাতে টাকা খরচ করে। এই টাকার জোরেই তারা দেশে ও বিদেশে গত সাড়ে তিন বছর ধরে চালাচ্ছে অপপ্রচার। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার ও গ্রেফতার শুরুর পর থেকে তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি টাকা পাচার করার যে খবর বিশ্বজুড়ে তোলপাড় তুলেছে। তাতেও আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। গত ১৮ জুলাই জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় লিড নিউজে বলা হয় যে, অর্থ পাচার এবং জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক দুটির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এইচএসবিসি ব্যাংকের। বিশ্বজুড়ে কালো টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে এইচএসবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। সেই কালো টাকার অংশ এসেছে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকেও এবং সেই টাকা নাকি খরচ হয়েছে জঙ্গী সংগঠনের তহবিলে। ব্যাংক দুটি অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক দেশীয় আইনে ব্যবস্থা নেবে বলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলেছে সদ্য পাস হওয়া মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন ঘটনার ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কালো টাকা পাচার এবং জঙ্গী অর্থায়নের খবর প্রকাশ করেছে এএফপি, আলজাজিরা এবং বিবিসি অনলাইন। তার মানে খবরটি একেবারে ফালতু নয়। এই রকম ভয়াবহ ব্যাপার সম্পর্কে আমরা সতর্ক করছি অনেক দিন ধরে। আমরা বার বার বলেছি যে, জঙ্গী এবং রাজাকারদের পিছে ঢালা হচ্ছে অঢেল অর্থ। তাদের সাংগঠনিক কর্মকা-, অস্ত্র, ট্রেনিং, গণমাধ্যমের জন্য খরচ হচ্ছে অর্থের একটা অংশ। অর্থ ঢালা হচ্ছে সিভিল সোসাইটি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনদের পিছেও। অর্থ ঢালা হচ্ছে দেশে এবং বিদেশে গণমাধ্যমের গর্তে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল করতে চালানো হচ্ছে ষড়যন্ত্র। এই মুহূর্তে দুর্বৃত্তদের লক্ষ্য যে কোন প্রকারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা এবং শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত। আঠারো কিংবা ছত্রিশ দলের জোটের শক্তিতে ভোটে জিতে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে শুরু হয়েছে ব্যাক ডোর দিয়ে ক্ষমতালাভের অনুশীলন। বলা হচ্ছে তৃতীয় শক্তির উত্থানের কথা। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে মাইনাস টু নয় মাইনাস ওয়ানের দুঃস্বপ্নও দেখছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার এক এগারোর চেয়েও ভয়ঙ্কর অর্থাৎ পাঁচগুণ বেশি শক্তির আগমনের অপেক্ষাও করছেন। অর্থাৎ এক-এগারোর জায়গায় তারা পাঁচ পঞ্চান্ন জাতীয় কিছু একটার প্রত্যাশা করছেন। সবকিছুর পেছনে অগ্রসরমাণ এবং ক্রমাগত আলোকিত হয়ে উঠতে থাকা বাংলাদেশের আকাশকে কালো মেঘে ঢেকে দেওয়ার অশুভ পাঁয়তারা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশটাকে অকার্যকর করতে, বাঙালী জাতির অহঙ্কারের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র হয়েই চলেছে। ষড়যন্ত্রের বিশাল আঘাতটি এসেছে পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মাধ্যমে। এর পর পরই হয়েছে জেলাভ্যন্তরে চারজন জাতীয় নেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার আঘাত। তারপর দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জনকে বিনষ্ট করে দেশটাকে মিনি পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা। সম্প্রতি পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের কথা দিয়ে কথা না রাখার ব্যাপারটিকে যদি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের চাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে কি খুব ভুল হবে? বিপুল ভোটে জনগণের রায় নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারে বসতে না বসতেই শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্রের চাল। শেখ হাসিনা সকল চাল ছিন্ন করে দেশটাকে নিয়ে চলেছেন সামনে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে তিনি যে অবস্থান নিয়েছেন তার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যিক শক্তি ও সাহস। বাঙালী জাতির আদি এবং মৌলিক চরিত্রের যথার্থ মুখপাত্র যেন তিনি। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার তীরবর্তী পবিত্র ভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি যে আহ্বান জানিয়েছেন সেটাই বাঙালীর হাজার বছরের চেতনা, দর্শন। বঙ্গবন্ধু এই চেতনার ভূমিতে দাঁড়িয়েই যুদ্ধ ও মুক্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালী বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আধুনিক, সশস্ত্র যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালীর বুকে ছিল হাজার বছরের চেতনা। প্রমাণ হয়েছিল যে বাঙালী কখনও মাথা নত করে না, পরাভব মানে না। এবারও পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বপ্ন শত সমালোচনার মুখে ছাই দিয়ে বাস্তবের চেহারা দেখবে। তাঁর আহ্বানে যে অভূতপূর্ব সাড়া মিলছে। দেশে-বিদেশে তা হেলাফেলা করার বিষয় নয়। গরিব কৃষক পর্যন্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে। হাত বাড়িয়েছেন শিক্ষক, পেশাজীবী, ব্যাংকার, বীমা প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ, প্রবাসী বন্ধুরা। আমি নিশ্চিত প্রয়োজনে স্বেচ্ছাশ্রম দেবেন দেশের ছাত্র-যুব সমাজের কোটি কোটি সদস্য। এগিয়ে আসবেন শিক্ষক-সংবাদকর্মী, কবি-সাহিত্যিকরাও। এগিয়ে আসবেন শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, খেলোয়াড়সহ বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকপক্ষও। চলচ্চিত্র শিল্পীরা যদি একটি ছবির পারিশ্রমিক প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে পদ্মা সেতুর জন্য প্রদান করেন অথবা প্রযোজকরা যদি একটি ছবি নির্মাণের এক-চতুর্থাংশও ব্যয় করেন, তাহলেও অনেক টাকা। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা যদি এক ম্যাচের টাকা দিয়ে দেন পদ্মা সেতু নির্মাণে, তাওবা কম কিসে। আসলে যেটা বলতে চাই, সেটা হলো প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে এগিয়ে এলে একদিকে যেমন অর্থবল বাড়বে। অন্যদিকে প্রমাণিত হবে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে আমরা আজও ঐক্যবদ্ধ হতে পারি একাত্তরের মতো। সত্য প্রতিষ্ঠার এই সুযোগ অবহেলা করলে সমূহ ক্ষতি।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.