ভারতের প্রথম বাঙালী রাষ্ট্রপতি প্রণব by মানস বন্দোপাধ্যায়

সম্পূর্ণ প্রত্যাশিতভাবেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইউপিএর প্রার্থী প্রণব মুখার্জী, বর্ধমানের মিরাটি গ্রামের পল্টু ভারতের ১৩ নং রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তিনি যে জিতবেন এটা ছিল সম্পূর্ণ দেয়ালের লিখন। এমনকি আমরা বহু আগে থেকেই ঝুঁকি নিয়ে সে কথা লিখেছি। নির্বাচনের দিনও প্রণবরা এ জন্যই ছিলেন টেনশনমুক্ত।


আর তার বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ থেকে প্রমাণিত হলো একটা দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটল। একজন যোগ্যতম ব্যক্তি ভারতের মতো বিশাল দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন।
মাত্র পাঁচ দিন আগেও প্রণবদা বলেছিলেন ১৩ সংখ্যাটি তাঁর পক্ষে শুভ। আনলাকি নয়। তাই তাঁর বারবাড়ন্তর সময়ে ১৩ তাকে অনুসরণ করেছে। শুভ্রা বউদিকে বিয়ে করেছেন ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই। এখন কয়েক বছর ধরে যে সরকারী বাস ভবনে থাকছেন সেটি ১৩ নং তালকটরা রোড। সংসদে তাঁর একতলার অফিসের রুম নং ১৩। গত ৪০ বছর ধরে লড়াই করলেও তার প্রকৃত উত্থান গত ১৩ বছর ধরে। শনিবারও তিনি বলেছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে না লড়লে ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেই অবসর নিতেন। সুতরাং আজকের জয় তার কাছে বরং একটা অতিরিক্ত পুরস্কার। তিনি এ জন্য দেশের সকল সাংসদ, বিধায়ক, সমর্থক এবং জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
প্রণব মুখার্জী ইউপিএর চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে পৃথকভাবে ধন্যবাদ জানান তাঁরা সৌজন্যমূলক সাক্ষাত করতে এলে। সোনিয়া এসেছিলেন রাহুলকে নিয়ে। সারাদেশ থেকে অসংখ্য অভিনন্দন আসছে। জয়ের জন্য ম্যাজিক সংখ্যা এসে যেতেই প্রণবদা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তাকে ধন্যবাদ জানান। সঙ্গে সঙ্গে মমতা তাকে অভিনন্দন জানান। রবিবার প্রণবদার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী শুভ্রাও উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী হরবংশ কাউর। আগামী ২৫ জুলাই তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেবেন।
বাংলাদেশেও প্রণব মুখার্জীর রাষ্ট্রপতি হবার সংবাদে খুশির লহরের খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে প্রণবকে মানা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর সারা বাংলাদেশে যখন অরাজকতা চলছিল তখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন জার্মানিতে ছিলেন। সেখান থেকে লন্ডন হয়ে শেখ হাসিনা দিল্লী পৌঁছলে দক্ষিণ দিল্লীতে তাঁকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়েছিল। সে সময় হাসিনা এবং এবং তাঁর বোনের দেখাশোনার ভার ইন্দিরা গান্ধী দিয়েছিলেন প্রণব এবং শুভ্রার ওপর। এই সময় থেকেই তাদের মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রণব এখনও সেটি বজায় রেখেছেন।
বাংলাদেশের ওপর তার একটা বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। সকল ভুল বোঝাবুঝি দূর করে মমতা বলেছেন তিনি ২৪ জুলাই রাতে দিল্লী আসবেন এবং প্রণবদার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। লোকসভার স্পীকার মীরা কুমারও তাঁর সঙ্গে দেখা করে অভিনন্দন জানিয়ে গেছেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইউপিএ জোট মনোনীত প্রার্থী প্রণব পেয়েছেন ৭ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৭ ভোট। অর্থাৎ প্রদত্ত মোট ভোটের ৬৯ দশমিক ৩১ ভাগ পেয়েছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার ৬৫ বছর পর প্রথম বাঙালী রূপে রাইসিনা হিলসের বাসভবনে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিজেকে নিশ্চিত করলেন প্রণব মুখার্জী।
অন্যদিকে বিজেপিসহ কয়েকটি বিরোধী দলের সমর্থনে প্রণবের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পিএ সাংমা পেয়েছেন ৩ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৭ ভোট, যা মোট ভোটের ৩০ দশমিক ৬৯ ভাগ। গত ১৯ জুলাই ভোট গ্রহণের পর রবিবার সকাল থেকে পার্লামেন্ট ভবনে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভোট গণনা হয়। বেলা ১১টায় ভোট গণনা শুরু হওয়ার পরই এমপিদের ৭২ শতাংশ ভোটে এগিয়ে যান প্রণব। ভারতের সংসদের দুই কক্ষে ৭শ’ ৭৬ জন সাংসদ ও চার হাজার ১২০ জন বিধায়ক মিলিয়ে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাজ্যসভা ও বিধানসভার ভোটমূল্য ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮২। নির্বাচনে জয়ের জন্য একজন প্রার্থীকে পেতে হয় ন্যূনতম পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার ৪৪২ ভোট।
১৯ জুলাইয়ের নির্বাচনে মোট ৭৪৮ এমপি ভোট প্রদান করেন। এর মধ্যে প্রণব লাভ করেন ৫শ’ ২৭ ভোট। বিরোধী প্রার্থী সাংমা পান ২শ’ ৬ ভোট। সমাজবাদী পার্টির প্রধান মুলায়েম সিং যাদব ১৫ ভোট পেলেও তা বাতিল বলে গণ্য হয়েছে। ভারতের নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একজন সদস্যের ভোটমূল্য নির্ধারিত হয় প্রত্যেক রাজ্যের মোট জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী। অর্থাৎ রাজ্যের প্রকৃত ভোটার আর বিধানসভা আসনের অনুপাতই হলো ওই রাজ্যের বিধায়কের ভোটমূল্য। পাশাপাশি দেশের মোট ভোটারকে লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্য সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। এভাবে রাজ্যসভা ও লোকসভার ভোটমূল্য নির্ধারিত হয়।
এদিকে ফল ঘোষণার আগেই প্রণব মুখার্জীর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হতেই তাঁর নিজ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে উল্লাসের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। মুখার্জীর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কীর্ণাহারের বাড়ির সামনে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। ঢাকুরিয়ার বাড়ি, মিরাটি ও বিধানভবনেও উৎসব শুরু হয়। তাঁর শুভানুধ্যায়ী এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রথম বাঙালী হিসেবে প্রণব রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ প্রকাশ করছেন। অনেককে মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখা গেছে।
প্রণব মুখার্জীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ॥ ভারতের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রণব মুখার্জী ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের মিরাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম কামদাকিঙ্কর মুখার্জী ও মা রাজলক্ষ্মী দেবী। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি ১০ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য হন কামদাকিঙ্কর।
ভারতের রাজনীতিতে চানক্য বলে পরিচিত প্রণব মুখার্জী ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে আইন বিভাগেও পাস করেন। একজন কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন। এ সময় ‘দেশের ডাক’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এ ছাড়া বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি ও পরে নিখিল-ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিও হন তিনি। ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই বাংলাদেশের নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গ্রামের শুভ্রা মুখার্জীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ১৯৬৯ সালে প্রথম রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন প্রণব মুখার্জী। সেই থেকে তাঁর যাত্রা শুরু।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, রাজস্ব ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। ভারত-মার্কিন বেসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দলের প্রতি আনুগত্য ও অসামান্য প্রজ্ঞা এ বাঙালী রাজনীতিককে কংগ্রেস দলে এবং দলের বাইরে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র করেছে। সাউথ ব্লকে তিনি পরিচিত ড্যামেজ কনট্রোল ম্যানেজার রূপে। দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ ও শ্রেষ্ঠ সংসদ সদস্যের পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকার এক সমীক্ষায় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রণব মুখার্জী ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস সেকশন ১২৩ চুক্তি সই করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অব গবর্নর্সের সদস্য। ১৯৮৪ সালে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রুপ অব টোয়েন্টিফোরের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৯৫ সালের মে থেকে নবেম্বর পর্যন্ত তিনি সার্ক মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেছিলেন। ২০১২ সালের ২২ জুলাই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ভারতের প্রথম বাঙালী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন।

No comments

Powered by Blogger.