হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে by নিয়ামত হোসেন

হুমায়ূন আহমেদ চলে যাওয়ায় দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর অসুস্থতার সময় থেকে দেশব্যাপী মানুষের উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা ছিল ব্যাপক। মৃত্যুর পর দেশের মানুষ শোকস্তব্ধ। এর পর থেকে সারা দেশে আলোচনা একটাইÑসেটা হুমায়ূন আহমেদ।


নানাজনের স্মৃতিচারণা, আলোচনা চলছে এখন পত্র-পত্রিকায় এবং টিভি চ্যানেলগুলোয়, পাশাপাশি চলছে মূল্যায়ন।
হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে প্রথমেই যে কথাটি বলা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, প্রকৃতঅর্থেই তিনি একজন প্রতিভাধর সব্যসাচী লেখক। যাতেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে তাতেই। গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি সফল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, পাঠক এবং দর্শকরা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করেছে তাঁর নাটক এবং চলচ্চিত্র।
তাঁর চমক ‘নন্দিত নরকে’। বইটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক সাড়া জাগায়, ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তারপর একের পর এক সাফল্য। পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সামনে এগিয়ে গেছেন ক্রমাগত। লেখার সঙ্গে সঙ্গে নাটকে তিনি এমন সাড়া তুললেন যা রীতিমতো ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তারপর চলচ্চিত্র, সেখানেও সফল তিনি। তিনি যেভাবে এগিয়ে গেছেন। যেভাবে একের পর এক কাজে হাত দিয়ে অগণিত পাঠক ও দর্শকের ভালবাসা পেয়েছেন তা বিস্ময়করই বলতে হয়। তিনি তাঁর কর্মজীবনে একের পর এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন।
আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে প্রকাশনা শিল্প। নানা সময়ে এই শিল্পে বহু ভাল সাহিত্যকর্ম তথা বই প্রকাশিত হয়েছে। সেসব যথেষ্টসংখ্যায় বিক্রিও হয়েছে। কিন্তু একটা পর্যায় আসে যখন বইয়ের পাঠক কমে যায়, ক্রেতাও কমে যায়। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এসে এক সময় বই বিক্রির ক্ষেত্রে একটা চমক সৃষ্টি করে ফেলেন। বই মেলায় তাঁর বই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লোকে কিনেছে, তাঁর অটোগ্রাফ নিয়েছে ভিড় করে। অপর লেখকদের বইও বিক্রি হয়, সামগ্রিভাবে বই বিক্রির পরিমাণও ভাল। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের বিক্রি যেন রেকর্ড সৃষ্টি করে। কোন বছরের বইমেলায় হুমায়ুনের নতুন বই একটা প্রকাশিত হলো অর্থাৎ বইটি মেলায় এলো। কয়েকদিনের মধ্যেই সে বইয়ের সব কপি শেষ। নতুন করে আবার সে বই ছাপাতে হয়েছে। একই মেলায় একটি বই একাধিকবার ছাপাতে হয়েছে বলে জানা যায়।
পাঠকরা তাঁর লেখায় আনন্দ পেত। সহজ-সাবলীল গদ্যে ঝরঝরে লেখা, লেখার ভেতরে রয়েছে রস, কৌতুক, হিউমার যা পাঠকের কাছে প্রিয়। সব বয়সের লোকই ছিল তাঁর লেখার পাঠক। তবে তাঁর লেখার বিশেষ ভক্ত ছিল উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে। এরা কি চায়, কি পছন্দ করে সেটা বুঝতেন হুমায়ূন আহমেদ। সে জন্য সবাই, বিশেষ করে নবীন বয়সী ছেলেমেয়েরা তাঁর বই কেনে এবং পড়ে। দেশব্যাপী তাঁর পাঠকসংখ্যা বহু, তবে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে তাঁর বই বিশেষ প্রিয়।
বলা হতো, বই বিক্রি হয় না, ক্রেতা নেই। কিন্তু ক্রেতা নেই বলা সত্ত্বেও দেখা যায়, সারা বছরই কেউ না কেউ বই কেনে। কিছু পাঠক আছেন যাঁরা কিছু না কিছু বই কেনেন। বইমেলাতেও বিভিন্ন স্টলে অনেকেই বই কেনেন। কোন স্টলে বিক্রি বেশি, কোন স্টলে কম। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের ব্যাপারে দেখা গেল, তাঁর বই এলে ক্রেতারা উপচে পড়ছে যেন, লাইন দিয়ে বই কিনছে। বেশ কিছুকাল ধরে বইমেলায় এই ঘটনা দেখা গেছে। হুমায়ূন আহমেদের বই যথেষ্ট বিক্রি হচ্ছে, নতুন বই এলে তো কথাই নেই! ক্রেতার লাইন আরও দীর্ঘ হয়!
এবারের বইমেলা কেমন হবে? হুমায়ূন আহমেদের বই এবারও নিশ্চয়ই অনেক বিক্রি হবে, অনেকেই অধিক আগ্রহ নিয়ে তাঁর বই কিনবে। কিন্তু তাঁর বইয়ের পাঠকরা কি অন্যদের বই কিনবে না?
হুমায়ূন আহমেদ বিপুলসংখ্যক পাঠক সৃষ্টি করেছেন, বিপুল সংখ্যক মানুষকে বইয়ের দিকে টেনেছেন এটা স্বীকার করতেই হবে। এই পাঠকরা যাতে ভাল তথা তাঁদের পছন্দের মতো বই পেলে কিনবেন না, তা হয় না। সেজন্য এক্ষেত্রে প্রকাশকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করা উচিত। দেশে ভাল লেখকের অভাব রয়েছে তা বলা যাবে না। অনেকে আছেন যাঁদের বই বছরের পর বছর বের হয় না। তাঁরা প্রকাশক পান না। প্রকাশকদের কাছে ঘুরেও অনেকেই বই প্রকাশের সুযোগ পান না। নবীনদের মধ্যেও এমন কেউ কেউ আছেন যাঁদের বই প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। আরেকটি প্রবণতা এখানে বেশ কিছুকাল ধরে দেখা যায়, অনেক লেখক-লেখিকাকে বই প্রকাশ করার জন্য টাকা দিতে হয়, হয় পুরো খরচ, নয়ত আংশিক খরচ দিতে হয়। তাই বই প্রকাশের স্বার্থে অনেকেই এভাবে বন্দোবস্ত করেন। এভাবে একটা-দুটো বই হয়ত প্রকাশ করা যায়, বেশি করা যায় না, তাই লেখার উৎসাহে ভাটা পড়ে। নতুন নতুন সৃষ্টি আর হয় না। নতুন নতুন লেখকের বই যাতে প্রকাশিত হয়, সে ব্যাপারে প্রকাশকদের সহযোগিতা পেলে সংশ্লিষ্ট লেখকরা নতুন নতুন লেখার ব্যাপারে উৎসাহ পেতে পারেন।
প্রত্যেক বছরের মতো এবারও বইমেলা হবে, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ থাকবেন না, এটা শুধু হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের ভক্তদের জন্যই নয়, সবার জন্যই দুঃখজনক। তবে হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত, পাঠক ও তাঁর বইয়ের ক্রেতারা অবশ্যই থাকবেন। তাঁদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে নতুন নতুন ভাল বই। হুমায়ূন যে পাঠকদের আকৃষ্ট করেছেন বইয়ের জগতে তাঁদের ধরে রাখতে হবে এই জগতেই। আমাদের প্রকাশনার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে গেছেন সেটাকে ধরে রাখা দরকার।
হুমায়ূন আহমেদের মূল্যায়ন আরও হবে। তাঁর অবদানের কথা মানুষ ভুলবে না। তাঁর মূল্যায়ন যেভাবেই করুক না কেন সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে যে উজ্জ্বলতার সঙ্গে বিরাজ করছিলেন সে কথা কেউ স্বীকার না করে পারবে না। কারণ হঠাৎই তাঁর আগমন এবং এসেই চমক সৃষ্টি। তারপর একের পর এক চমক। উপন্যাসের চরিত্র, গল্পের চরিত্র, নাটকের চরিত্রগুলো পাঠক-দর্শকদের মনে এমনভাবে ছাপ ফেলে রেখেছে যা সহজে বিস্মৃত হবার নয়। তাঁর সৃষ্ট কোন কোন চরিত্র, তাঁর লেখা কোন কোন ঘটনা শুধু চমকই সৃষ্টি করেনি, কোন কোনটা সারা দেশে যেন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অগণিত মানুষকে বাংলা বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন, তাদের আনন্দ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছেন, ধরে রেখেছেন তাঁদের সুস্থ-আনন্দময় ধারায়Ñ এটা তাঁর বিরাট কৃতিত্ব। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে উচ্চ আসনে হবে তাঁর স্থান।

No comments

Powered by Blogger.