ঈদ টার্গেটে নেমেছে চাঁদাবাজরা নেপথ্যে পলাতক সন্ত্রাসীরা by পারভেজ খান

গত ১১ জুলাই। রাত আনুমানিক সোয়া ৮টা। রাজধানীর ২০/২ পশ্চিম পান্থপথে এফারি ট্রাক কম্পানি নামে একটি অফিসে ঢোকে সন্ত্রাসী সম্রাটের নেতৃত্বে স্থানীয় একটি চাঁদাবাজ গ্রুপ। সামনে ঈদ। তাদের পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে। বিপদে পড়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াসির আরাফত চাঁদা দিতে রাজি হন।


তবে সময় নেন এক দিন। চলে যায় সন্ত্রাসীরা। তবে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় ধরা পড়ে চাঁদাবাজদের এই তৎপরতা। অনেকের হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও দেখা যায়।
পরদিন চাঁদা দেওয়ার তারিখ। ইয়াসির সন্ত্রাসীদের আসতে বলেন স্থানীয় একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয়। সম্রাট নিজে না গিয়ে অন্য দুজনকে পাঠায়। কলাবাগান থানার পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে তারা। তবে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ছবিতে যাদের লম্ফঝম্ফ করতে দেখা গেছে, সেই শীর্ষ সন্ত্রাসী সম্রাট, সালাউদ্দিনসহ উপস্থিতদের অনেকে এখনো পলাতক।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ঈদ সামনে রেখে ইতিমধ্যেই রাজধানীতে এ ধরনের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। এটা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজদের তৎপরতা কিছুটা বাড়ে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নিজেরা মাঠে না নেমে তাদের পক্ষ থেকে ভাড়াটে লোকদের দিয়ে চাঁদাবাজি করছে। এই ভাড়াটেরা প্রায় সবাই নতুন ও অচেনা। ফলে তাদের শনাক্ত করাটা কঠিন। এ ছাড়া দেশের বাইরে আত্মগোপন করে থাকা কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইতিমধ্যেই ঢাকায় চলে আসায় এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন রূপ নিয়েছে। এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর অপরাধ রাজ্যের বাসিন্দারা বৈঠক করে চাঁদাবাজিতে আধিপত্য চালানোর জন্য এলাকা ভাগ করে নিচ্ছে, যাতে নিজেদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি না হয়। যেসব সন্ত্রাসী দেশের বাইরে আত্মগোপনে আছে, তারা সেখান থেকেই দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যদের নির্দেশনা দিচ্ছে। বন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীরা দল নিয়ন্ত্রণ করছে কারাগারের ভেতর থেকেই। কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য সঠিক বলে জানা গেছে।
রাজধানীর নিউ মার্কেট, গাউসিয়া মার্কেট, মিরপুর রোড, ফকিরাপুল, মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ এলাকা, মিরপুর ও শেওড়াপাড়া এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ইতিমধ্যেই তাঁরা চাঁদাবাজদের ফোন পেয়েছেন। ঈদের কমপক্ষে ১৫ দিন আগে তাদের চাঁদা দিতে হবে। মিরপুর রোডের ফার্নিচার ব্যবসায়ী আলমাস জানান, শাহাদত কলকাতা থেকে তাঁকে ফোন করে বলেছে, 'ছোট ভাইরা আট রমজান দেখা করবে, ওদের পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে দিবেন। না হলে বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঈদ করতে পারবেন না। দেশের বাড়িতে সবার লাশ প্যাকেট করে পাঠিয়ে দিবে। আর আমার লোক ছাড়া অন্য কেউ চাঁদা দাবি করলে আমার ছেলেদের জানাবেন। ওরা সব ম্যানেজ করে দিবে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী এই প্রতিবেদককে বলেন, পরিস্থিতি আগের মতো নেই। প্রেক্ষাপট অনেক পাল্টে গেছে। তাদের শীর্ষ সন্ত্রাসী বলা হলেও মূল কলকাঠি আরেক মহলের হাতে। এই মহল রাজনৈতিক। ফলে তারা যে টাকা পায়, এর সিংহভাগ দিতে হয় ওদের। এই নিয়ম আগেও ছিল, কিন্তু এখন অনেক বেশি বেড়ে গেছে। বিভিন্ন সময় ক্রসফায়ারসহ নানা ঘটনায় যেসব সদস্য মারা গেছে, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও টাকার একটা অংশ দিতে হয়। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে রাজধানী থেকে আদায় হওয়া চাঁদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই চলে যাবে দেশের বাইরে পলাতক বড় ভাইদের হাতে। আর এর বাইরে পুলিশ ম্যানেজ খরচ তো আছেই।
অপরাধজগতের এক সূত্রে জানা গেছে, কিলার খোরশেদ ঈদ চাঁদাবাজির জন্য কিছুদিন আগে ভারত থেকে ঢাকায় এসেছে। মতিঝিল এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে তাকে কয়েক দিন আগে দেখা গেছে বাবুল তালুকদার নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করতে। সিলভার রঙের একটি গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ায় কিলার খোরশেদ। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে একজন ছিল হান্নান। সে নিখোঁজ আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকতের ছোট ভাই। সম্প্রতি পুলিশের তালিকা থেকে হান্নানের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। হান্নান এখন প্রকাশ্যে ঘুরছে।
পুলিশের নথিতে রামপুরা এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহজাদা। সে বর্তমানে কারাগারে থাকায় এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য এখন খায়ের ও শাহিন নামে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। এই দলে আছে সন্ত্রাসী ঘাতক স্বপনের (মালয়েশিয়ায় পলাতক) বড় ভাই রিপন, পিচ্চি সোহেল, জহির ও ফয়সাল। এলাকায় এখন এই সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী হচ্ছে কারারুদ্ধ শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা পলাশের সহযোগী গুঁজা বাদশাহ, তপু, কিলার পলাশ, রাজীব, শাওন ও জাভেদ। বাদশাহ ও তপু তাদের দলনেতা। এ ছাড়া পিয়াস-ডিজিটাল কামাল গ্রুপ নামে আরো এক সন্ত্রাসী দল আছে এ এলাকায়। ঈদ সামনে রেখে তিনটি গ্রুপই এখন গার্মেন্ট সেক্টরে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। তারা ভারতীয় আগ্নেয়াস্ত্র ও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পাশের হাজীপাড়া, মালিবাগ ও চৌধুরীপাড়ার গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করছে শীর্ষ সন্ত্রাসী টুনু ও মনি। তারা দুজন ভিন্ন দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। শান্তিনগর এলাকায় চাঁদাবাজি করছে পিচ্চি শামিম ও তার সহযোগীরা। সিদ্ধেশ্বরীর ফ্রিডম রাসু কারাগারে। তার হয়ে চাঁদাবাজি করছে তার ছোট ভাই বাচ্চু এবং শিমুল ও শিশির।
মতিঝিল ও ফকিরাপুল এলাকার ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এবং বিভিন্ন মার্কেটে চাঁদাবাজি করছে শোভন, মিন্টু, শাহিন, কামাল, শটগান সোহেল, রিয়াজ ও কিলার তারেক। তারেক আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল।
পুরান ঢাকার ত্রাস ডাকাত শহীদ কয়েক দিন আগে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। তবে চাঁদাবাজি বন্ধ নেই। সন্ত্রাসী বাঙ্গাল মামুন, দাঙ্গা লিটন, আরমান, এরফান, রাসেল, ভাগ্নে রনি, শাহজাহান, কালা মিন্টু, মুহিদ (ডাকাত শহীদের ডান হাত ছিল), চশমা নাসির, টিপু, লাবলু, সোহেল, রাসেল, মাহবুব, মুন্না, সোর্স আজমল এই এলাকায় চাঁদাবাজি করছে।
রাজধানীর তেজগাঁও-ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার এখনো শীর্ষ সন্ত্রাসী এল রহমান, ইরান, কিলার আশিক, চিটার জিল্লুর, মামু শাহজাহান, বাবুল ওরফে টাওয়ার বাবুল, আনোয়ার, লেংড়া শাহিন, বাচ্চু, মোশারফ, নবী সোলায়মান ও পলাতক জাকিরের (সুইডেন আসলামের ভাই) নিয়ন্ত্রণে। কারারুদ্ধ সুইডেন আসলামের স্ত্রী আয়েশাও একটি সন্ত্রাসী দল পরিচালনা করে চাঁদাবাজি করছে।
মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, ধানমণ্ডি আর লালমাটিয়ায় চাঁদাবাজি করছে কালা ফিরোজ, সেভেন স্টার গ্রুপের কালা খলিল, ফ্রিডম সবুজ, পিচ্চি তুহিন ওরফে মাতবর তুহিন, মজিবর, শামিম ও ডিশ শাকিল। ডিশ শাকিলের বাসা ধানমণ্ডির মধুবাজারে। সে ছিনতাইকারীও। তার মা বেদেনাও শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী। শাকিল ডিশ সংযোগ ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবার ব্যবসা করে আসছে। বেদেনার সঙ্গে পুলিশের ভালো সম্পর্ক থাকায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
মোহাম্মদপুর এলাকার চাঁদাবাজিতে শীর্ষ অবস্থানে আছে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার সাইদ ব্যাপারীর ছেলে শামিম, আরেক সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার সলুর ভাতিজা মনির আর সন্ত্রাসী তুহিন। শামিম ও মনির একে অপরের প্রতিপক্ষ। দুজনই বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকে। মনিরের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। ঈদ সামনে রেখে মনির গ্রুপ ইতিমধ্যেই আসাদগেট ও টাউন হল এলাকায় কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছে।
রাজধানীর মগবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত, মুকুল, মোল্লা মাসুদ ও রনি দেশের বাইরে। তাদের অবর্তমানে মগবাজারের চাঁদাবাজি এখন সন্ত্রাসী ফখরুলের নিয়ন্ত্রণে। কাঁঠালবাগান, কলাবাগান আর গ্রীন রোড এলাকায় চাঁদাবাজি করছে সাগর হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নীরু আর তার সহযোগীরা।
মহাখালী, বাড্ডা ও গুলশান-বনানী এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে শীর্ষ সন্ত্রাসী আলমগীর-জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর যুক্তরাষ্ট্রে ছিল দীর্ঘদিন। এখন দেশে। তারা দুই ভাই একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনা করে। এ ছাড়া এ এলাকার আরো কয়েকজন প্রভাবশালী চাঁদাবাজ হচ্ছে মিলু, কালা নাসির, আসলাম, হাসিফ, আলম, পনু, সাইদ, মনির, ইন্ডিয়ান বাবু, স্টেন রাজিব, জঙ্গি ও হাজারী মিলন। মূলত ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ই তাদের প্রধান পেশা।
খিলগাঁও তালতলা এলাকায় চাঁদাবাজি করছে আওলাদ, জুয়েল, মোস্তাক ও রানা। পাশের গোড়ানে হান্নান, সবুজবাগ বাসাবোতে আজাদ, গোপীবাগে নান্নু ও ইলিয়াস। ফুলবাড়িয়া এলাকায় চাঁদাবাজি করছে বাচ্চু ও তার শ্যালক আউয়াল। আউয়াল বংশাল এলাকারও চিহ্নিত সন্ত্রাসী।

No comments

Powered by Blogger.