মৃত্যুর পর ডিজিটাল সম্পত্তির কী হবে?

টরেন্টোর ৫৮ বছর বয়সী লর্ন গ্লাডস্টোন। এ বয়সে অন্য কাজে ব্যস্ত না থেকে তাঁর প্রধান ঝোঁক কীভাবে ডিজিটাল সম্পদগুলো রক্ষা করা যায়। মা-বাবার মৃত্যুর পর গ্লাডস্টোনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁদের লিখিত দলিল দস্তাবেজগুলো সংরক্ষণ করা।

গ্লাডস্টোন বলেন, ‘আমি অবাক হই তখনই যখন আমার সন্তানেরা লিখিত কাগজপত্রের সঙ্গে খুবই কম পরিচিত।’ একজন সফটওয়্যার নির্মাতা হিসেবে ভার্চুয়াল সম্পত্তিগুলো ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক কারণে গ্লাডস্টোনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব সম্পত্তি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা রয়েছে।
আবেগ প্রকাশের মাধ্যম ও ব্যবসায়িক কারণে অনলাইনের গুরুত্ব বাড়ছে। তবে প্রচলিত আইন অনুযায়ী এসব অনলাইন উপকরণ সংরক্ষণ ও ভবিষ্যত্ মালিকানার ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে।
ডিজিটাল সম্পদের মধ্যে রয়েছে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, ডাউনলোড করা বিভিন্ন বিষয়, অনলাইন গেম, সামাজিক যোগাযোগ অ্যাকাউন্ট ও ই-মেইলগুলো। ব্রিটেনে ডিজিটাল সংগীতের সত্ত্বের মূল্যও ৯০০ কোটি পাউন্ড বা এক হাজার ৩০০ কোটি ডলারের বেশি হয়। চীনের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে একজন বলেন, তাঁদের পাঁচজনের মোট পাঁচ হাজার ইউয়ান (৭৯০ ডলার) মূল্যের ডিজিটাল সম্পদ রয়েছে। এসবের মূল্য কেবল অর্থ দিয়েই পরিমাপ করা যায় না।
এ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম রয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানি তাদের গ্রাহকদের নিজেদের নিয়ম-কানুনে আটকে রাখে। অনেকেই ব্যবহারকারীদের একটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের সুযোগ দিলেও মৃত্যুর পর তাঁর অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে এ অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের অনুমতি দেয় না। কেবল ফেসবুক বিভিন্ন গ্রাহকদের একটি সুবিধা দিয়েছে যার মাধ্যমে নিকট কোনো আত্মীয় তাঁর স্বজনের অ্যাকাউন্টটি বন্ধ কিংবা স্মৃতিমূলক পাতা হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারে।
গুগল নিয়ন্ত্রিত জি-মেইল একজন নির্বাহীর কাছে তাদের গ্রাহকদের ই-মেইলের একটি অনুলিপি দেয়। অ্যাপলের সংগীত ডাউনলোড ওয়েবসাইট আই টিউনস এ গ্রাহকদের লাইসেন্স নিতে হয়। তবে এ লাইসেন্স কেবল বহাল থাকবে গ্রাহকের জীবনকাল পর্যন্ত। অ্যাপলের আই ক্লাউড সার্ভিসের ব্যবহারকারীদের মৃত্যুর পরপরই সব তথ্য হারিয়ে যায়। নিজস্ব এসব রেকর্ড-নীতি নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করেনি অ্যাপল।
এদিকে বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর গ্রাহকদের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালার কারণে আমেরিকায় মামলাও হয়েছে। ২০০৪ সালে জাস্টিন এলসওয়ার্থ নামে ইরাকে নিহত এক মার্কিন মেরিন সেনার পরিবার তাঁর ই-মেইল চেয়ে ইয়াহুর বিরুদ্ধে মামলা করে মিশিগান আদালতে। তবে এ মামলার রায় সম্পর্কে জানা যায়নি। চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনের একটি আদালত এক মামলায় এ মর্মে রায় দেন, যেকোনো মৃত ব্যক্তির মা তাঁর ছেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। তবে সেটা হবে স্বল্প সময়ের জন্য।
বর্তমানে মৃত ব্যক্তিদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রশাসকদের ক্ষমতা খর্ব করে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি অঙ্গরাজ্যে আইন হয়েছে। তার পরও একজন মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ব্যবহারে গোপনীয়তার প্রশ্নটি থেকেই গেছে। কারণ, সংগীত শোনা হলো এক বিষয়। আর অন্যান্য বিষয়, যেমন ফেসবুকের অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করা অন্য বিষয়। কারণ কোনো ব্যক্তিই চান না, তাঁদের গোপন অ্যাকাউন্ট বা ই-মেইলগুলো তাঁর নিকটাত্মীয়রা দেখুক।
এ বিষয়ে লন্ডনের আইনজীবী কলিন পিয়ারসন বলেন, কেবল একটি উইলে স্বাক্ষর করে বিস্তারিত নিয়ম-কানুন মানার পরই অন্য ব্যক্তির উচিত কারও সম্পত্তি ব্যবহার করা। ভারতের নয়াদিল্লির ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ গুরপ্রীত সিং বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে কেউ কেউ তাঁদের ডিজিটাল সম্পত্তির উইল করেছেন। লোকজন আস্তে আস্তে তাঁদের সম্পত্তির মূল্য বুঝতে পারছেন। এ ধরনের ডিজিটাল সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে নতুন একটি শিল্প গড়ে উঠছে। সিকিউরসেইফ নামে সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি বলেছে, তাদের ১০ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে। কোম্পানি গ্রাহকদের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণের পাশাপাশি মৃত্যুর পর ব্যবহারকারীদের একটি তালিকা তৈরি করে।
এসব সত্ত্বেও একটি বিষয় সামনে চলে আসে। বিদ্যমান আইন, উইল ও পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর শর্তের সঙ্গে ডিজিটাল সম্পত্তি সংরক্ষণ কোম্পানিগুলোর সংঘর্ষ চলছে। এ সমস্যা তখনই ঘনীভূত হয়, যখন তথ্যের নিয়ন্ত্রক হয় এক দেশের আর তথ্য-উপাত্ত হয় অন্য দেশের। বর্তমানে এ নিয়ে মাথাব্যথা জীবিত ব্যক্তি আর আইনজীবীদের।
—ইকনমিস্ট অবলম্বনে

No comments

Powered by Blogger.