চিরকুট-তুষারপাত by শাহাদুজ্জামান

নোবেল বিজয়ী মার্কেজের জগত্খ্যাত উপন্যাস হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড-এর চরিত্র বুয়েন্দিয়ার জীবনে স্মরণীয় একটি দিন, যেদিন সে প্রথম বরফ দেখে। উষ্ণ কলম্বিয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামের নিরীহ বুয়েন্দিয়ার কোনো ধারণাই ছিল না যে জগতে বরফ নামক একটি বস্তুর অস্তিত্ব আছে। জীবনে প্রথম বরফ দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। বরফের শীতল গায়ে হাত রেখে এক ধরনের আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগে তার।


চারদিকে ঘন তুষারে ঢাকা বিলাতের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ মুহূর্তে আমার অবস্থা খানিকটা বুয়েন্দিয়ার মতো। তবে বুয়েন্দিয়ার মতো গরম দেশের মানুষ হলেও বরফ বিষয়ে তার মতো আনকোরা থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি, তাহলে তুষারপাত নিয়ে অনুভূতিটা তার মতোই ম্যাজিকাল হতো। তা ছাড়া তুষারপাত দেখার অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেকবার। কিন্তু এবারের বিস্ময়ের মাত্রা আরও ব্যাপকতা নিয়ে। অভূতপূর্ব এক তুষারপাতের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ব্রিটেন এবার। খোদ ব্রিটেনবাসীরই বিস্ময় কাটছে না এ তুষারপাত নিয়ে। তারা বলছে, গত প্রায় অর্ধশতাব্দীতে এমন তুষারপাত দেখেনি তারা। অচল হয়ে পড়েছে রাস্তা। যে লবণজাত পদার্থ দিয়ে তারা রাস্তার বরফ পরিষ্কার করে থাকে, তাতে আর কাজ হচ্ছে না। বন্ধ করে দিতে হয়েছে এয়ারপোর্ট, ট্রেন চলাচল, স্কুল, কলেজ। পুরো দেশ পরিণত হয়েছে বিশাল এক রেফ্রিজারেটরে, আর সেই হিমের ভেতর আটকে স্থবির হয়ে আছে মানুষ। জানা যাচ্ছে, এই ব্যাপক তুষারপাতে নানা ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতি হয়ে গেছে ব্রিটেনের। কোপেনহেগেন থেকে সদ্য জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলাপ সেরে দেশে ফিরে তার আক্ষরিক প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনকে। মানুষের মনে আতঙ্কের জন্ম হয়েছে। অজানা আশঙ্কায় দোকানপাট শূন্য করে লোকজন জিনিসপত্র, খাবার-দাবার কিনে মজুদ করছে ঘরে। এ দেশে বয়স্ক নারী-পুরুষ শীতে ‘থার্মাল আন্ডারওয়ার’ নামে বিশেষ একধরনের অন্তর্বাস পরে থাকে। পত্রিকা জানিয়েছে, এবারের শীতের প্রচণ্ডতায় ভয় পেয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ধুম পড়েছে ওই অন্তর্বাস কেনার। থার্মাল আন্ডারওয়ারের বিক্রি বেড়েছে এক হাজার গুণ। পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে দেশে হঠাত্ শিশু প্রসবের হার বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। আতঙ্কের কারণে অনেক গর্ভবতী নারীর প্রসব-বেদনা দেখা দিয়েছে সময়েরও আগে।
যে পাড়ায় থাকি, একদিন সেখানে বিদ্যুত্ চলে গেল। ভারী তুষারপাতের কারণে বৈদ্যুতিক সংযোগে ত্রুটি হওয়ায় এমনটি ঘটছে ব্রিটেনের নানা এলাকায়। এও এক অস্বাভাবিক ঘটনা এ দেশে। এখানে বাড়ির আলো নিভে যাবে ভাবিনি, ফলে তেমন কোনো প্রস্তুতিও নেই। ঘরে মোমবাতি, টর্চ নেই। এই হিমে রাতে ঘরের হিটার না চললে মারা পড়তে হবে। অন্ধকারে অনেকটা সময় বসে থেকে শেষে তিন-চারপ্রস্ত কাপড় পরে বেরোলাম বাইরের পরিস্থিতি বুঝতে, প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করতে। রাস্তার মোড়ে দেখি বড়সড় জটলা। প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছেন। এ ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরাও অপ্রস্তুত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। যেন বিশাল এক ঘটনা। এদিকে এদের জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ ফোনের বন্যা শুরু হওয়ায় সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, একেবারে মৃত্যুঝুঁকির কোনো বিষয় না হলে এ নম্বরে ফোন করা চলবে না। আমার প্রতিবেশীরা নানা বিকল্প স্থানে ফোন করে সমস্যাটি জানতে সক্ষম হলেন। তবু তাঁদের উদ্বিগ্নতা যায় না। একজন ত্রস্ত প্রতিবেশী তাঁর ক্রিসমাস উত্সবের উদ্বৃত্ত কিছু মোমবাতি এগিয়ে দিলেন আমাকে। এঁদের কাতর অবস্থা দেখে আমার খানিকটা কৌতুকবোধ হলো। বাতিহীন রাত আমাদের নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতার অংশ। এ ছাড়া আরও কত বহুমাত্রিক অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে চলতে হয় আমাদের। অথচ অস্বাভাবিক এক তুষারপাত রীতিমতো নাজেহাল করে তুলেছে ব্রিটেনবাসীকে। নানা রকম নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকা সত্ত্বেও বিপদ আর অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় তাঁদের শক্তি সীমিত হয়ে এসেছে। এ নিয়ে তাঁদের নিজেদের ভেতরেই ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পত্রিকায় দেখলাম, অক্সফোর্ডশায়ার কাউন্টির প্রধান ক্ষুব্ধ হয়ে বলছেন, ‘এ কোন ব্রিটেন আজ আমাদের সামনে? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা হিটলারকে হারিয়েছি আর সেই আমরা কি না এক তুষারপাত দেখে এমন ঘাবড়ে গেলাম?’
আমি রোদ, বৃষ্টি আর ঘামের দেশের মানুষ, তারা যখন হিম-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, আমি বরং এই ব্যাপক তুষারপাতের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার দিকে মনোযোগী হই। রবার্ট ফ্যাহার্টির নানুক অব দি নর্থ ছবিতে দেখেছিলাম তুষারজীবন। রবফঘর ইগলুর ভেতর হাসি, কান্না আর প্রেম। জেনেছিলাম, অন্য সব ভাষায় বরফ শব্দটির গোটা তিন-চারেক প্রতিশব্দ থাকলেও বরফময় এস্কিমোর ভাষায় রয়েছে এক ডজনেরও বেশি ধরনের বরফের গল্প। চকিত এক এস্কিমো নগর হয়ে উঠেছে ব্রিটেন। আমি ভারী ওভারকোট গায়ে, হাতমোজা আর শীতটুপি মাথায় তুষারে গোড়ালি ডুবিয়ে হাঁটি। বৃষ্টির মতো সশব্দে নয়, নীরবে, সন্তর্পণে ভেজা তুলার মতো চারদিক ছেয়ে ধীরে ধীরে তুষার আলত করে পড়ে আমার গায়ে। ঢেকে দেয় চারপাশ, বাড়ির ছাদ, গাড়ির ছাদ, বৃক্ষ। ধবধবে সাদা চরাচর। তুষারে মোড়ানো গাছের ডালের ফাঁকে দেখি ঝাপসা চাঁদ। পাশে বুয়েন্দিয়াকে পাওয়া গেলে আমরা দুই উষ্ণ পৃথিবীর মানুষ মিলে উপভোগ করতাম তুষারে ঢাকা পৃথিবীর অভিনব সৌন্দর্য। ঘন তুষার মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, বুঝি বা মেঘের ওপর হেঁটে হেঁটে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ার এন্ডারসনের তুষারকন্যা আর সাত বামনের দেশে যাচ্ছি।
যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল থেকে
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.