ভাষাসৈনিক মাহফিল আরা আজমত by নাসরীন মাশকুরা রোকন

আমার আম্মা, যার নামের আগে কিছু বিশেষণ যুক্ত না করলে নামের অপূর্ণতা থেকে যায়। তিনি একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, ভাষাসৈনিক, শিল্প-সংস্কৃতি সাধক, সমাজসেবক ও সংস্কারক, বন্ধু ও দরিদ্র-বত্সল মহীয়সী নারী অধ্যাপক মাহফিল আরা আজমত।

’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ফেব্রুয়ারির এ মহান ভাষা আন্দোলনের মাসে এই ভাষাসৈনিককে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তিনি ছিলেন দেশের এবং বিশেষ করে চট্টগ্রামের গৌরব। অধ্যাপক মাহফিল আরা ১৯২৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া গ্রামে জমিদার বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যপূর্ণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়িতে ইসলামী বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য গভর্নেস থাকা সত্ত্বেও এই মহীয়সী নারীর বাবা ও চাচাদের স্বপ্ন ছিল তাদের মেয়ে একদিন জজ-ব্যারিস্টার হবেন। তাই চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন তার দূরদর্শী বাবা খান বাহাদুর কবির উদ্দিন আহমেদ তাকে কলকাতায় ‘কৃষ্ণনগর ক্রাইস্টচার্চ মিশনারি স্কুল’-এ ভর্তি করে দেন। ১৯৪৪ সালে তিনি এই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতার স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী কলেজ ‘লেডি ব্রেবর্ন’ থেকে ১৯৪৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট করেন। তারপর ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে অর্থনীতি বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিপ্লোমা ইন অ্যাডুকেশন (বিএড)’ করেন এবং ১৯৫৬ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মনোবিজ্ঞান বিভাগে এমএড ডিগ্রি লাভ করেন। উল্লেখ্য, তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম মহিলা এমএড (সূত্র : ন্যাশনাল আর্কাইভ, আগারগাঁও ঢাকা)। একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়েও তিনি মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভূমিকা পালন করেছেন তা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয় এবং তিনি ছিলেন একজন সাহসী, স্বাধীনচেতা ও মহীয়সী নারী। ছোটবেলা থেকেই ফেব্রুয়ারি মাসে আম্মা আমাদের ভাইবোনদের কাছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করতেন এবং অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে সেসব গল্প শোনাতেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। ওই সময় ভাষা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। তারা রাত জেগে পোস্টার লিখতেন ও স্লোগান তৈরি করতেন। সকালে দু’জন দু’জন করে সামনের সারিতে মেয়েদের নিয়ে মিছিল বের করতেন। পুলিশের টিয়ার গ্যাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেয়েরা শাড়ির আঁচল পানিতে ভিজিয়ে নিতেন। পুলিশের আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতেন, তারপর আবারও মিছিল নিয়ে অগ্রসর হতেন। তাদের স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’, ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’। রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর সেই রক্তমাখা শার্ট ঝুলিয়ে রেখে তারা মিছিলে বের হতেন। সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি আন্দোলনের পুরো সময়টাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটান। ফেব্রুয়ারিতে তার বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। এদিকে উত্তপ্ত সেই পরিস্থিতিতে হবু শ্বশুরবাড়িতে প্রচারিত হয়েছিল তাদের হবু পুত্রবধূ মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আন্দোলনের শেষে তিনি হল ত্যাগ করে ঘরে ফিরে যান। ১৯৫২ সালের ৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের সাতকানিয়া থানার চাকফিরানি (বর্তমানে লোহাগাড়া) গ্রামের মিয়াবাড়ির ডেপুটি আসাদ উল্লাহ সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র আজমত উল্লার (এমকম, ঢাবি, টিসিই গার্নেট কলেজ, লন্ডন) সঙ্গে বিয়ে হয়। ১৯৫৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করে তিনি স্বামীর সঙ্গে রাজশাহীতে তার প্রথম সংসার শুরু করেন। স্বামী অধ্যাপক আজমত উল্লাহ রাজশাহী কলেজের অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন এবং তিনি ওই সময় পিএন গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মরহুম বাদশা মিয়া চৌধুরীর আমন্ত্রণে তিনি রাজশাহী ত্যাগ করে চট্টগ্রামে চলে আসেন। বাদশা মিয়া চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং এই বিদূষী মহিলার প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস প্রিন্সিপাল। তিনি সুদীর্ঘ ১৬ বছর অর্থনীতি ও মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনার পাশাপাশি ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপনা করেন। ৬ বছর পর ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বেতারে লাইভ প্রোগ্রাম ‘টক’ চলাকালীন স্ট্রোক করে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। এখানেই তার কর্মজীবনের সমাপ্তি এবং প্যারালাইসিস অবস্থায় থাকাকালীন ১৯৯৩ সালের ১৭ আগস্ট তিনি পরলোক গমন করেন। অধ্যাপক মাহফিল আরা ছিলেন নিরঙ্কুশ একজন সমাজসেবক। তিনি নিজ অর্থ ব্যয়ে দুস্থদের বিয়ে, শিক্ষা ও চিকিত্সার ব্যয়ভার বহন করতেন। তিনি লায়নসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বন্যা ও সাইক্লোনের সময় তিনি রিলিফ ফান্ডের আয়োজন ও বিতরণ করতেন, এমনকি রমজান মাসে বস্তিবাসীর মাঝে বরফ ও ঠাণ্ডা পানি বিতরণ করতেন। সমাজের সব শ্রেণীর জন্য তার এ অবদান চট্টগ্রামবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এই মহীয়সী নারীর স্বামী প্রিন্সিপাল প্রফেসর আজমত উল্লা ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কন্যা শিরীন আজমত একজন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী এবং মঞ্চ ও চট্টগ্রাম বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। তার স্বামী লে. কর্নেল এনামুল হক চৌধুরী পিএসসি (অব.)। ছেলে সাজ্জাদ উল্লা (এমএসএস অর্থনীতি) ব্যাংকার। তার স্ত্রী ডা. রোকসানা নাসরীন (এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি, এফআরসিপিএস, কানাডা) একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। কন্যা নাসরীন মাশকুরা রোকন (এমএসএস, বিএড, সমাজবিজ্ঞান) একজন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রিন্সিপাল, স্বামী মেজর জেনারেল রোকনউদ্দৌলা (এনডিসি, পিএসসি), সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সাদউল্লা চট্টগ্রাম ইপিজেডে কর্মরত এবং তার স্ত্রী পলিটিক্যাল সাইন্সে এমএ শেষ বর্ষের ছাত্রী। মহান ভাষা আন্দোলনের এই দিনে সব ভাষাসৈনিকের পাশাপাশি আমার আম্মাকে আমি, আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

No comments

Powered by Blogger.