সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ-আমেরিকার নতুন নিশানায় ইয়েমেন by এফ উইলিয়াম এংডাহল

মাস কয়েক হলো মার্কিন সামরিক বাহিনী ইয়েমেনকে নিশানা করেছে। সম্প্রতি আবদুল মুত্তালেব নামের যে নাইজেরীয় যুবককে মার্কিন বিমানে নাশকতার অভিযোগে আটক করা হয়েছে, বলা হচ্ছে তাঁর প্রশিক্ষণ হয়েছিল ইয়েমেনের আল-কায়েদা শিবিরে। ইয়েমেন দুঃখজনকভাবে দরিদ্র এক দেশ।


সৌদি আরবের গা-ঘেঁষা এই দেশের পশ্চিমে লোহিত সাগর, দক্ষিণে এডেন উপসাগর গিয়ে পড়েছে আরব সাগরে। এর পাশ দিয়েই দুনিয়ার বেশির ভাগ তেল সরবরাহ হয়। সোমালিয়ার অবস্থানও এই গুরুত্বপূর্ণ তেলপথের পাশে। সূত্রমতে, বিশ্বের বৃহত্তম তেলের মজুদও রয়েছে ইয়েমেন আর সৌদি আরবের মাঝখানের অঞ্চলে। কিছুদিন হলো সোমালিয়ার পাশাপাশি ইয়েমেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। সোমালিয়ার জলদস্যুতার ঘটনা যেমন তাদের জন্য অছিলা হয়েছিল, ইয়েমেনে আল-কায়েদার ঘাঁটি করার অভিযোগ তাদের দিয়েছে নতুন অজুহাত। পেন্টাগন ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ অঞ্চলের সামরিকায়নে তোড়জোড় চালাচ্ছে।
ইয়েমেনে আল-কায়েদার আবির্ভাবের অভিযোগটি কেন বেখাপ্পা লাগে, তা বুঝতে সোমালীয় ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিতে হবে। ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে ইয়েমেনের ছকে দাবার ঘুঁটিগুলো নড়তে-চড়তে শুরু করে। এক সাবেক জিহাদি নেতা তারিক আল-ফাধিল সরকারের সঙ্গে ১৫ বছরের জোট ভেঙে দক্ষিণ ইয়েমেনের সরকারবিরোধী শক্তিশালী আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন। আশির দশকে তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদদের নেতা ছিলেন। সাউদার্ন মুভমেন্ট নামের ওই বিরোধী পক্ষের অন্যতম প্রধান নেতা হওয়ায় বিরোধী পক্ষ অনেক শক্তিশালী হয়ে গেল।
ইয়েমেন আগে ডান ও বাম হিসেবে বিভক্ত ছিল। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েত সমর্থনধন্য দক্ষিণ ইয়েমেন দুর্বল হয়ে গেল। এর কিছু পরে উত্তর ইয়েমেনের সঙ্গে দক্ষিণ ইয়েমেন একীভূত হয়। এই ঐক্য সাময়িক আশাবাদ তৈরি করলেও অচিরেই উভয় অংশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ ইয়েমেনের সামরিক অংশ বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহর স্বৈরতন্ত্রী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সালেহ ১৯৭৮ সাল থেকে প্রথমে উত্তর ইয়েমেনের শাসক হিসেবে, পরে ১৯৯০ সাল থেকে যুক্ত ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক ব্যক্তির শাসন চালিয়ে আসছেন। ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থনে তিনি দক্ষিণের সাবেক মার্ক্সবাদীদের বিদ্রোহকে পরাজিত করেন। বিদ্রোহীরা ছিল ইয়েমেন সোস্যালিস্ট পার্টির সদস্য। ১৯৯০ সালের আগে কমিউনিস্টদের ঠেকাতে সৌদি আরব ও আমেরিকা সালেহর ইসলামীকরণকে মদদ দিয়ে যায়। ফাধিলও ছিলেন এই কাজের সহযোগী। এখন ফাধিল বামপন্থীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় দাবার চাল উল্টে গেল। সালেহ তখন অস্তিত্ব টেকানোর জন্য সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশের মুখাপেক্ষী হন। ২০০৮ সাল থেকে তেলের দাম পড়তে থাকলে ইয়েমেনের অর্থনৈতিক অবস্থাও দারুণ নাজুক হতে থাকে। তেলের রাজস্ব থেকেই ইয়েমেনের ৭০ শতাংশ আয় হয়। এবং এই তেলক্ষেত্রগুলো সব দক্ষিণ ইয়েমেনে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অধিষ্ঠান উত্তরে। এই হলো পটভূমি।
এই নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে কিছু নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে একটি ঘোষণা প্রকাশিত হয় যে আল-কায়েদা ইয়েমেনে তাদের শাখা খুলেছে। এই শাখার দ্বিতীয় প্রধান নেতা হলেন আবু-সায়াফ-আল-শিহরি। শিহরি গুয়ানতানামো কারাগারে বন্দী ছিলেন। এটা এখন প্রতিষ্ঠিত যে গুয়ানতানামোয় চরম নির্যাতন করেও সত্য বের করা যায়নি। অনেকেই মনে করেন, সত্য বের করা নয়, সিআইএ ও পেন্টাগনের জেরাকারীদের মূল উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে নিজেদের এজেন্টে পরিণত করা। এটা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা সমান কঠিন। তাহলেও আল-কায়েদার কথিত ইয়েমেনি শাখায় দুজন গুয়ানতানামো বন্দীর উপস্থিতি কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।
আল-কায়েদা ইয়েমেনে আল-ফাধিল ও দক্ষিণের আন্দোলনের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে। ২০০৯ সালে ফাধিল ঘোষণা করেন যে ‘আমরা ১৫ বছর ধরে দখলদারির অধীন। আমরা এই দখলদারিবিরোধী লড়াই নিয়েই ব্যস্ত, দুনিয়ার অন্য কারও সমস্যায় পীড়িত হওয়ার সময় আমাদের নেই। আমরা আমাদের স্বাধীনতা ফিরে পেতে চাই।’
দক্ষিণের এই স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাপকভিত্তিক জনপ্রিয় আন্দোলন এবং তা আল-কায়েদার বৈশ্বিক জেহাদ তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কথিত রয়েছে যে ইয়েমেনে আল-কায়েদার সদস্যসংখ্যা মাত্র ২০০। কিন্তু এই খুদে আল-কায়েদা গোষ্ঠীর অজুহাতেই এই কৌশলগত নিরাপত্তা অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালাতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা ইয়েমেনের সমস্যাকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বললেও গত ১৭ ডিসেম্বর সেখানে বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তাদের চালকহীন বিমান পাকিস্তানের মতো করে দক্ষিণ ইয়েমেনে বোমাবর্ষণও করেছে। আল-কায়েদা থাকার কোনো প্রমাণ না দিতে পারলেও, ডেট্রয়েটে বিমান হামলা চালানোর অভিযোগে আটক আবদুল মুত্তালেবের সঙ্গে ইয়েমেনের কোনো যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও, ইয়েমেন এখন হয়ে উঠছে আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নতুন শিকার।
ইয়েমেন, জিবুতি ও ইরিত্রিয়ার মাঝখানের বাব এল-মান্দেব হলো মার্কিন সরকারি তালিকায় সাতটি গুরুত্বপূর্ণ তেল সঞ্চালনকেন্দ্রের একটি। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থার মতে, বাব এল-মান্দেবের জলপথ বন্ধ হয়ে গেলে একদিকে পারস্য উপসাগর থেকে আসা তেলবাহী জাহাজগুলোকে অনেক ঘুরপথে যেতে হবে, তেলের পাইপলাইন ব্যাহত হবে। ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে ভারত মহাসাগরের কৌশলগত সংযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। ২০০৬ সালের হিসাবে এই সংকীর্ণ জলপথ দিয়ে প্রতিদিন ৩৩ লাখ ব্যারেল তেল ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ায় এবং ২১ লাখ ব্যারেল যায় ভূমধ্যসাগরে। চীনের তেলের জোগানও আসে এই পথে।
যেকোনো অজুহাতে এ অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মানে আরেকটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ তেলপথে আমেরিকা ও ন্যাটোর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া। এটা হলে চীন, ইউরোপ বা অন্য কোনো দেশ যদি আমেরিকার নীতির বাইরে যায়, তাহলে তাদের তেল পাওয়া অনিশ্চিত করে তোলা সম্ভব হবে। সৌদি আরবেরও বিরাট অংশের তেল এই পথ দিয়ে যায়। সম্প্রতি তারা চীন বা অন্য কোনো দেশে ডলারের বদলে অন্য কোনো মুদ্রায় করার চিন্তা করছে। কিন্তু তা করার আগে এখন সৌদি আরবকে কয়েকবার ভাবতে হবে।
একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে ইয়েমেনের মাটির তলায় রয়েছে বিপুল তেলের মজুদ। এটা দিয়ে বিশ্বের আগামী ৫০ বছরের তেলের চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে আমাকে জানিয়েছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। সুতরাং ছন্নছাড়া ও কাবু হয়ে যাওয়া আল-কায়েদা নিয়ে মাতামাতির থেকে ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে আরও বিরাট স্বার্থ। তবে আল-কায়েদাকে তার প্রয়োজন সত্যিকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ লুকানোর ঢাল হিসেবে। আল-কায়েদাও সেটাই করে যাচ্ছে।
গ্লোবাল রিসার্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ।
এফ উইলিয়াম এংডাহল: মার্কিন সাংবাদিক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.