সপ্তাহের হালচাল-অনুপ চেটিয়া: রাজনৈতিক মেয়াদি বোমা by আব্দুল কাইয়ুম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর উপলক্ষে একটি মহল যখন বাংলাদেশের ‘নতজানু’ পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগে সোচ্চার হয়ে ওঠে, ঠিক সেই সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একটি রাজনৈতিক মেয়াদি বোমা ছুড়ে দেন।


অভিযোগ করেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর সঙ্গে কারাবন্দী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার দেড় ঘণ্টার বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। বিএনপির নেতারা বলেন, প্রমাণ দিন। সৈয়দ আশরাফ বলেন, প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না। একটা রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়ে যায়।
১৯৯৮ সালে গ্রেপ্তারের পর থেকেই অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। বিএনপি বলে, তাঁকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না, কারণ তাহলে উলফা ক্ষিপ্ত হয়ে বাংলাদেশে নাশকতামূলক হামলা শুরু করবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সম্প্রতি মূল উলফা নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে গেলে এ ধরনের প্রচার আরও বেড়ে যায়। বিএনপি মহল এ জন্য আওয়ামী লীগের ‘নতজানু’ পররাষ্ট্রনীতিকেই দায়ী করতে থাকে। এর বিপরীতে এবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ হাটে হাঁড়ি ভাঙার মতো করে যে কথা বললেন, তার অর্থ দাঁড়ায়—আওয়ামী লীগ নয়, বরং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারই বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কারণ, তাঁর অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়ায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মহলবিশেষের পৃষ্ঠপোষকতায় উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসাজশে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এটা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।
অবশ্য সৈয়দ আশরাফের অভিযোগ সত্য হলে ও তিনি ‘জাতির সামনে’ প্রমাণ হাজির করতে পারলেই কেবল এই শেষোক্ত সিদ্ধান্তটি সত্য বলে গৃহীত হবে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন। অনুপ চেটিয়া তখন কারাগারে। তাঁকে যদি অভিযোগ অনুযায়ী জেলখানা থেকে বের করে এনে হোটেল শেরাটনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে, সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার কাজ করে। তারা এমন প্রভাবশালী যে, জেলখানার বন্দীকে বের করে আনা তাদের কাছে নস্যি। এভাবে তারা বিপজ্জনক আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতের বীজ বপন করতে পারে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ব্যবস্থাপনা এত দুর্বল যে, বন্দীদের নিরাপত্তা দিতে বা তাদের ওপর বাইরের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে তারা অনেক সময় ব্যর্থ হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের সময় ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর জেলখানা থেকে খুনিচক্রকে বের করে এনে অস্ত্র হাতে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গুরুতর অভিযোগ হলো, ওই খুনিদের গোলাগুলিতে ডা. মিলন শহীদ হন। এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয় নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান।
১৯৭৫ ও ১৯৯০ সালের ঘটনা দুটির যথাযথ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা যদি হতো, তাহলে ২০০২ সালে আবার কাউকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জেলখানা থেকে বের করে আনার অভিযোগ তোলার মতো কোনো ঘটনা ঘটতে পারত না। জেলহত্যায় সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভিযুক্ত হয়েছে। মিলন হত্যাকাণ্ডের পেছনেও যদি কারাবন্দী খুনিচক্রকে বের করে আনার অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে, তাহলে সেটাও করা সম্ভব হয়েছে তত্কালীন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের হস্তক্ষেপে। কারণ, এরশাদের সময় সবকিছুই সম্ভব ছিল। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের কিছু সদস্যকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কাজে ব্যবহারের অভিযোগ অনেক পুরোনো। কখনো এসব অভিযোগ নিয়ে খোলামেলা তদন্ত হয় না বলে কেউ এগুলো সত্য বলে দাবি করতে পারেন না, যেমন পারেন না এ নিবন্ধের লেখকও। কিন্তু সত্য উদ্ঘাটিত না হওয়ার ফল হলো, কথাগুলো ডালপালা ছড়ায় এবং আরও বিকট আকারে প্রচারিত হতে থাকে।
উলফা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য গত ১৮ ডিসেম্বর আমি কলকাতায় সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে দেখা করে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করি। সুবীর ভৌমিক বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের পূর্ব ভারতীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি গবেষণামূলক কাজও করেন। তাঁদের পারিবারিক আদি বাসস্থান ছিল বৃহত্তর কুমিল্লার নবীনগরে। আসামের একটি পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতায় নিয়োজিত ছিলেন। পূর্ব ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ও ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রয়েছে। তাঁর লেখা ট্রাবলড পেরিফেরি ক্রাইসিস অব ইন্ডিয়াস নর্থইস্ট বইটি গত মাসে বেরিয়েছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে বের হয় তাঁর লেখা বই ইনসারজেন্ট ক্রসফায়ার।
আলোচনাকালে সুবীর ভৌমিক বলেন, আশির দশকে উলফার ঘাঁটি ছিল মিয়ানমারে। সেখানে কাচিন স্বাধীনতাকামীরা তাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করত। সে সময় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাচিনদের একটা লেনদেন হয়। তারা উলফাকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে। তখন উলফা মিয়ানমার থেকে সব ঘাঁটি গুটিয়ে বাংলাদেশের দিকে আসে। বাংলাদেশে তাদের প্রথম যোগাযোগ হয় পাকিস্তানমনা সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে। এভাবে তারা বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। তাঁর কথাগুলো আমরা গ্রহণ করতে পারি বা নাও পারি। দ্বিমত পোষণ করলেও কিন্তু এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, পাকিস্তানঘেঁষা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মদদে উলফা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে তাদের নাশকতামূলক তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছিল।
চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে সুবীর ভৌমিক বলেন, উলফা নেতাদের অনেকে ঢাকায় গোপন পরিচয়ে থাকতেন, এমনকি ‘উলফার সামরিক শাখার প্রধান পরেশ বড়ুয়া সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে খেলতেনও। তিনি ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয়ে সকালে হাঁটতে আসা অনেকে তাঁকে কোনো ফুটবল ক্লাবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এ সময়ের একটা ছবিও আমার কাছে আছে। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমার নতুন বইয়ে এটিসহ আরও কয়েকটি ছবি ছাপানোর কথা ছিল। কিন্তু বইয়ের দাম বেড়ে যাবে বলে পরে আর ছাপানো হয়নি। খেলতে গিয়ে গোপন পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পরেশ বড়ুয়া ওই এলাকায় যাওয়া বন্ধ করেন, মগবাজার এলাকার বাড়িও বদলে ফেলেন।’
সম্প্রতি সরকার আমাদের দেশের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহারের কোনো সুযোগ না দেওয়ার বলিষ্ঠ নীতি গ্রহণ করেছে। শুধু কথায় নয়, কাজেও এর প্রমাণ সরকার দিচ্ছে। এটাই সঠিক নীতি ও অবস্থান। বলার অপেক্ষা রাখে না, অনুপ চেটিয়ারা বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক মেয়াদি বোমাবিশেষ। তাদের নিয়ে খেলার ছলে নাড়াচাড়া করলে বিপদের আশঙ্কা আছে। কখন যে কার বিরুদ্ধে সেই মেয়াদি বোমার বিস্ফোরণ ঘটবে, বলা মুশকিল। রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়ে পরিণত না করে দেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কূটনৈতিক রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন। এতে দেশের সুনাম বাড়বে, বিপদের আশঙ্কা কমবে। এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দল উভয়েরই সমান দায়িত্ব।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও বিশেষভাবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে খুব দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এখানে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল) কারিয়াপ্পার (১৮৯৯-১৯৯৩) একটি ঘটনা উল্লেখ করা চলে। সর্বমহলে সমাদৃত ও স্বনামধন্য এই জেনারেল অবসর গ্রহণের পর একবার করাচি সফরে যান। তখন পাকিস্তানে আইয়ুবি সামরিক শাসন। সব দেখে-শুনে মার্শাল কারিয়াপ্পা পাকিস্তানে সেনা শাসনের অধীনে সমাজে শৃঙ্খলা ও দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেন এভাবে, যার অর্থ দাঁড়ায় এমন—যেন ভারতের গণতন্ত্র কত অদক্ষ ও স্থবির, আর পাকিস্তানের সামরিক শাসন কত চৌকস ও গতিশীল। এই মন্তব্যে ভারতের সব মহলে ছি ছি পড়ে যায়। সমালোচনার প্রবল ঢেউ ওঠে। শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু জেনারেল কারিয়াপ্পাকে ডেকে বুঝিয়ে দেন, পাকিস্তানের আইয়ুবি সামরিকতন্ত্রটি আসলে ভারতের গণতন্ত্রের তুলনায় নিকৃষ্ট।
আজ দেখুন গণতন্ত্র ভারতকে কোথায় উঠিয়েছে, আর সামরিকতন্ত্র পাকিস্তানকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছে। এখন তো পাকিস্তানের অস্তিত্বের সংকট চলছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে সেনাবাহিনী ও সর্বোচ্চ আদালতের দ্বন্দ্ব চরমে। এর পরিণতি পাকিস্তানকে যে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ জানে না। তালেবানদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাত তো আছেই। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে মানুষ মরছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রথম শর্ত হলো, গণতন্ত্র শক্তিশালী করা এবং গণতন্ত্রের অধীনে সামরিক নেতৃত্বকে সমর্পণ করা। সেখানে কোনো সংস্থা যেন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমান্তরালে না চলে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এর দায়িত্ব যেমন রাজনৈতিক সরকারের, তেমনি সামরিক নেতৃত্বেরও। সরকারের মূল নেতাদের কাছে আবেদন, অনুপ চেটিয়াদের মতো রাজনৈতিক মেয়াদি বোমাগুলো গণতন্ত্রের ওষুধ দিয়ে নিষ্ক্রিয় করুন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.