এই নগরীর দিনরাত্রিঃ নগরে নগরে আতঙ্ক by রেজোয়ান সিদ্দিকী

এই নগরে কত কারণে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কখনও ছিনতাইকারীর আতঙ্ক। কখনও ওয়াসার বিল চেককারীর আতঙ্ক। কখনও ডাকাতের আতঙ্ক। কখনও বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লুর আতঙ্ক। কখনও বা মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টির আতঙ্কে নাগরিকরা দিশেহারা হয়ে পড়ে।

এছাড়া নানান কিসিমের প্রতারকের আতঙ্ক কখনও কখনও নগরবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ আতঙ্ক ছড়ায়ও নানাভাবে। কখনও কেবলই মুখে মুখে, কখনও প্রচার মাধ্যমের বেহিসেবি প্রচারণায়। কখনও বা ই-মেইল, টেলিফোনে কোনো কোনো সময় কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের নামে টেলিফোনে চাঁদাবাজির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে নগরীর বিভিন্ন মহলে। একটা আতঙ্ক যায় আরেকটা আসে। নগর মানুষের যেন আতঙ্ক এক জীবনসঙ্গী।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন নগরীর এই মুহূর্তের আতঙ্ক গ্রেফতার। গ্রেফতার কেন? কেন ভাই আমাকে আটক করতে এসেছেন? সোজা জবাব ৫৪ ধারায়। আপনাকে দেখে কিংবা আপনার আচরণ চালচলনে সন্দেহ হয়, আপনি বোধ করি রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিছু করতে যাচ্ছেন। কী ভয়ঙ্কর কথা? আল্লাহতায়ালা আমার চেহারা যেমন দিয়েছেন আমি তেমনই। আমি তো আমার চেহারা পরিবর্তন করতে পারব না। আপনার কেন আমাকে সন্দেহ হয়? কারণ, আপনি আমাকে দেখতে নারেন, আমার তাই চলন বাঁকা। আমি আইন মান্যকারী নাগরিক। নিজে কোনো অপরাধ করা তো দূরের কথা, কোনো অপরাধীর সঙ্গে আমার পরিচয়ও নেই। বড় ধরনের অপরাধ তো দূরের কথা আমি জীবনে কোনোদিন ট্রাফিক সিগন্যালও ভায়োলেট করিনি। আমাকে কেন যে আপনার সন্দেহ হয়!
হ্যাঁ, সন্দেহ হয়। এই সন্দেহের খেলা এখন চলছে নগরে নগরে, এছাড়াও সন্দেহের আরও অনেক কারণ। ঘরের ভেতরে পরিত্যক্ত চিকন তার পাওয়া গেছে। বোমা টোমা বানায় না তো? আরও পাওয়া গেছে চে’ গুয়েভারার জীবনী। বিপ্লব রফতানি করতে চায় না তো। নাকি সরকার উত্খাত করে কোনো বৈপ্লবিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়? ঘরে পাওয়া গেছে কোরআন-হাদিস, চার খলিফার জীবনী, মৃত্যুর আগের ও পরে মোকসেদুল মোমেনিন কিংবা ইসলামবিষয়ক কোনো গ্রন্থ। সব্বোনাশ! এতসব জেহাদি বই আছে ঘরে। তাহলে নিশ্চয়ই সে হুজি কিংবা তালেবান জঙ্গি। আটকাও তারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন খুন হয়েছে। সরকারের হোমড়া-চোমড়ারা হুমকি ছেড়েছেন শিবিরের আস্তানা ভেঙে দিতে হবে। ব্যস! পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে এখন সারা দেশের আনাচে-কানাচে খুঁজে বেড়াচ্ছে কোথায় শিবির থাকে। কোথায় জামায়াতের আবাস। সেগুলো তছনছ করে দেয়া হচ্ছে। শ’য়ে শ’য়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার করে রিমান্ড নামক এক আতঙ্ক পিঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা সন্তানের নিরাপত্তা ও শিক্ষার কথা ভাবছে। কি হবে? কেউ জানে না। এতে নিরীহ শিক্ষার্থীরা গ্রেফতার হচ্ছে। গ্রেফতার হচ্ছে সারা দেশে। রাজশাহীতে ছাত্রলীগ কর্মীর হত্যায় ঝিনাইদহের যে শিবির কর্মী গ্রেফতার হয়েছে সে কোনোদিন হয়তো রাজশাহী যায়ইনি। রাজশাহীর আমের গল্প শুনেছে। লিচুর গল্প শুনেছে। রেশমের গল্প শুনেছে, পদ্মার মরে যাওয়া কাহিনী শুনেছে। সেও গ্রেফতার হয়ে গেছে রাজশাহীতে ছাত্র হত্যার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে।
এর নাম কি শাসন। না। এর নাম দমন এবং পীড়ন। এতে উত্কণ্ঠিত, আতঙ্কিত, শান্তিপ্রিয় প্রতিটি নাগরিক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে যথেষ্ট সিট নেই। ছাত্রদের তাই মেস করে থাকতে হয়। পিতা-মাতা হয়তো জানেও না তার সন্তান ছাত্রলীগ করে না শিবির করে। কিংবা কোনো দলই করে না। গ্রামে ফিরলে হয়তো তাকে উপদেশ দেয়, ভালোভাবে লেখাপড়া কর, দলাদলি হানাহানিতে যেও না। তিনিও হয়তো শুনছেন তার সন্তান গ্রেফতার হয়ে গেছে, তার রুমে ইসলাম ধর্মবিষয়ক বই থাকায়। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এ কোন আপদ এসে জুটেছে। হাজার হাজার অভিভাবক আতঙ্কে আছে। তার সন্তান টাঙ্গাইলের আবু বকর সিদ্দিকের মতো লাশ হয়ে ফিরবে না তো? কিংবা জামায়াত-শিবির বলে সন্দেহ করে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো? ধরে নিয়ে গেলে আইনি লড়াইয়ের সামর্থ্যও তার নেই। তাহলে সংসারের অন্যদের মুখের অন্ন জুটবে কেমন করে। এই সব—এ আতঙ্কের ভেতর এখন নাগরিকদের বসবাস। কোথায় যাব? কোন দিকে যাব? কার কাছে যাব—কেউ জানে না।
অচেনা হয়ে যায়
নগরীর মানুষ সারাক্ষণ রাজনীতি করেন না। কিংবা রাজনীতির ধান্ধায়ও থাকেন না। তারা ব্যস্ত থাকেন জীবন-জীবিকার ধান্ধায়। ভোটের সময় হলে তারা ভোট দেয়। বেশিরভাগ নাগরিক নীরবে ভোট দিয়ে নীরবেই চলে আসেন। তাদের মধ্যে অতি নগণ্যসংখ্যকই জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ দিতে রাস্তায় বের হন। বাকিরা নিভৃতে চলে। অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকেন। রাতের বেলা খবর কিংবা টেলিভিশনের টক শো দেখেন। তারপর ঘুমিয়ে যান। সকালে ওঠে আবারও জীবন-জীবিকার ধান্ধা, এই নাগরিকদের জীবন এমনই নিস্তরঙ্গ। তারা এমন নিস্তরঙ্গ জীবনই পছন্দ করেন। দেশব্যাপী যখন আন্দোলন-সংগ্রামের জোয়ার ওঠে তখন এরা আতঙ্কিত হন। স্বাভাবিক জীবন-যাপন বাধাগ্রস্ত হলে তার রুটি-রুজির কী হবে? সেটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এরা ঝুট-ঝামেলা মোটেও পছন্দ করে না। আন্দোলন-সংগ্রামের মিছিল দেখেন দূর থেকে। যদি সেগুলো তার আকাঙ্ক্ষানুকূল হয় তবে মনে মনে খুশি হন। যদি হয় আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী তবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এদের মধ্যে যাদের বয়স তুলনামূলকভাবে কম অর্থাত্ ৩০-এর কোঠায় তারা এই নগরীর অনেক পারিপার্শ্বিক দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠেছেন, এই নগরীর অনেক স্থাপনার ইতিহাসও তাদের জানা। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে চীন বাংলাদেশকে গড়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। সঙ্গতভাবেই তার নাম রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র। কী যে সরকারকে পেয়ে বসল তারা হুট করে এর নাম বদলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র করে বসল। নাগরিকদের কাছে এই সুরম্য স্থাপনাটি বহুল পরিচিত। সংক্ষেপে তারা একে বলতেন চীন মৈত্রী। অর্থাত্ অনুষ্ঠানটি কোথায়—সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল চীন মৈত্রীতে। এখনও সেটাই সবাই বলে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন খ্যাতিমান লোকদের নামে বিভিন্ন রাস্তার পুনঃ নামকরণ করেছে। কিন্তু সেসব নামকরণ কেবল ফলকে লেখা আছে। নাগরিক সেগুলোকে পুরনো নামেই ডাকেন, পুরনো নামেই চেনেন। নতুন নাম কেউ ব্যবহার করেন না।
এখন ৩০-৩৫ বছরের যুবক যারা, তারা জন্মেই জেনেছেন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সংক্ষেপে জিয়া হয়েছে। সারা পৃথিবীর বিমান চলাচল ব্যবস্থায় বাংলাদেশের এই বিমানবন্দরটি জিয়া নামেই পরিচিত। দীর্ঘকাল ধরে এই পরিচিতিই বহাল আছে। কিন্তু হুট করেই সরকার এর নাম বদলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা হীনম্মন্যতায় শঙ্কিত হচ্ছে। হয়তো এটি নিয়েই নগরে সংঘাতের সৃষ্টি হবে। এ সরকার কিছুই নির্মাণ করতে চায় না। নির্মিত স্থাপনার নাম ফলকগুলো কেবলই বদলে দিতে চায়। কেবলই চেনা বিষয়গুলোকে অচেনা করে ফেলতে চায়। সংঘাতে আশঙ্কায় শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের উদ্বেগ বাড়ে।
একুশের উত্সব
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে শহীদ হয়েছিলেন চারজন। তারপর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৪০ সালে লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। সেই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। তারপর থেকেই তত্কালীন বুদ্ধিজীবী মহলে এই দুই অঞ্চল নিয়ে সরকারি ভাষা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। কী হবে সম্ভাব্য সেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা? সেই বিতর্কে বাংলাদেশ তথা পূর্ববাংলার মানুষের দাবি ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে দুটি। বাংলা এবং উর্দু। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট এই দুই অঞ্চল নিয়েই গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই আবারও বিতর্ক জমে ওঠেছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার মানুষের ওপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৫২ সালে ছাত্ররা সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একুশে ফেব্রুয়ারি। সে সময় পুলিশের গুলিতে চারজন শাহাদত বরণ করেন। এই ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়।
এরপর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি শোক দিবস গোটা পাকিস্তানের শাসনকাল জুড়ে পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে সেমিনার-সভা সমিতি যেমন হয়েছে, তেমনি নগর জুড়ে মিলাদ মাহফিল ও কাঙালি ভোজেরও আয়োজন করা হয়েছে। ভোরবেলায় কালো ব্যাজ ধারণ করে খালি পায়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি এক উত্সব দিবসে পরিণত হয়েছে। এখন খালি পায়ে প্রভাত ফেরি দেখা যায় না। কালো ব্যাজও বাধ্যতামূলক নয়। গান-বাজনা-সঙ্গীতে মুখরিত থাকে এই দিন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একুশের বইমেলা। সব মিলিয়ে উত্সব আর উত্সব। এভাবেই সম্ভবত কোনো কোনো শোক নগরীতে শেষ পর্যন্ত উত্সবের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
ফুটনোট
ক’দিন আগে আমার এক তরুণ বন্ধু টেলিফোনে জানতে চাইলেন, আমি শফিক রেহমানের মোবাইল নম্বর কিংবা ই-মেইল ঠিকানা জানি কিনা। কৌতূহলবশত আমি জানতে চাইলাম, ‘হঠাত্ আপনার শফিক রেহমানের নম্বর কেন দরকার’? তিনি বললেন, ‘তার কাছে কিছু টাকা পাওনা হয়েছি। বিলটা পাঠিয়ে দেব।’ আমি তো আশ্চর্য, শফিক রেহমানের কাছে আপনি কেমন করে টাকা পান? তিনি বললেন, ‘আগে তো ঈদ, জন্মদিন, নববর্ষে প্রিয়জনকে উপহার দিলেই হতো। এই শফিক রেহমান ভালোবাসা দিবস চালু করে আমার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাই বিলটা তাকে পাঠাব।’

No comments

Powered by Blogger.