মানুষের শত্রুমিত্রঃ রং চড়ানো ইতিহাস-৬ by মাহমুদ শামসুল হক

হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহচর গোয়েবলস বলেছিলেন, একটি মিথ্যাকে বারবার সত্য বলে চালিয়ে দিলে তা সত্যে পরিণত হয়। এই অসত্ পরামর্শের পরিণতি তিনি নিজেই দেখে গেছেন। ঝোলা গুড়কে শেষ পর্যন্ত মধু বলে বিক্রি করা যায়নি। তার পরও বিশেষ করে চতুর রাজনীতিকরা সুযোগ পেলেই এই গোয়েবলসীয় তত্ত্বটি প্রয়োগ করেন।

ভাড়াটে ও বশংবদ ইতিহাস লেখকরা তা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। এভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে। সমকালে কিংবা যুগ-যুগান্ত ধরে পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় ভুল বার্তা। তা থেকে তর্ক বাঁধে, জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, গোত্রীয় সংঘাত থেকে খুনোখুনি এমনকি যুদ্ধবিগ্রহও হয়ে থাকে। এ ধরনের ভ্রান্তিবিলাস অপনোদনের দায়িত্ব ঐতিহাসিকের। ইতিহাস গবেষকরা বাজার চলতি ইতিহাস লেখকদের বিস্তর ভুলচুক নির্দেশ করেছেন। এখানে তারই এক প্রস্থ নিয়ে আলোচনা করছি।
মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খানকে মুসলমান বলে উল্লেখ করেছেন কোনো কোনো ইংরেজ ইতিহাস লেখক। চেঙ্গিস নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত। কাজেই মুসলিম বিদ্বেষ থেকে তাকে মুসলমান বলা হয়েছে। অথচ কবে তিনি মুসলমান হয়েছিলেন তা বলেননি। অন্যদিকে কতিপয় মুসলিম ইতিহাস লেখক চেঙ্গিসকে মুসলমান বলে অভিহিত করেছেন এ জন্য যে, তিনি ছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর, মোগল বংশের পূর্বপুরুষ। আবার একশ্রেণীর ঐতিহাসিক চেঙ্গিসের নামের ডানে ‘খান’ দেখে আর কোনো দিকে তাকাননি। সোজাসুজি বলে দিয়েছেন, চেঙ্গিস খান ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। শত শত বছর ধরে এদের রচিত ইতিহাস পড়ে মানুষ এ তথ্যকেই ঠিক বলে জেনেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এই বিতর্ক উসকে দেয়ার জন্য দুই-একজন লেখক ‘খান’ পাল্টে লিখেছেন খাঁ। অর্থাত্ চেঙ্গিসের মুসলমানিত্বকে আরও মজবুত করার প্রয়াস পেয়েছেন। অথচ তথ্যটি ভুল। এসব ইতিহাস রচয়িতারা জানতেন না কিংবা জানলেও গোপন করে গেছেন যে ‘খান’ মোঙ্গল জাতিতে প্রচলিত একটি খেতাব। তাতার-মোঙ্গলদের ভাষায় ‘খান’ অর্থ নেতা। চেঙ্গিস খান সে অর্থেই খান, মুসলমান অর্থে নন। ‘খান’ পরবর্তীকালে একটি মুসলিম গোত্রের পদবি হিসেবে গৃহীত হয়। ‘খাঁ’ শব্দটিও মুসলমানিত্ব প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ ভারতীয় হিন্দুদের একটি সম্প্রদায় নামের শেষে খাঁ লেখে, পরিচয় দেয়। যেমন—অরবিন্দ খাঁ, সরস্বতী দেবী খাঁ ইত্যাদি। অথচ ‘খান’ বা ‘খাঁ’ শব্দ দুটি কয়েকশ’ বছর ধরে মানুষের স্মৃতিতে এতটাই পোক্ত হয়ে মিশে আছে যে, চেঙ্গিস খান নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একজন মুসলিম নরপতি বা সেনানায়কের প্রতিমূর্তিই সামনে এসে দাঁড়ায়।
শুধু নাম বিভ্রান্তিই নয়, একাধিক ইতিহাস লেখক চেঙ্গিস খানের জীবনী লিখতে গিয়েও অতিরঞ্জনের শিকার হয়েছেন। যেমন—চেঙ্গিসের জন্মের সময় তার দুই হাতের মুষ্ঠিতে জমাট রক্ত ছিল। এই অভিনব দৃশ্য দেখে তত্কালে জনৈক মোঙ্গল মনীষী ভবিষদ্বাণী করেছিলেন যে, এই বালক ভবিষ্যত্ জীবনে ব্যাপক রক্তপাত ঘটাবে এবং হত্যাকাণ্ডের কাজে লিপ্ত থাকবে। আসলে এ কল্পনাটি ইতিহাস লেখকের মাথায় আসে চেঙ্গিস খান যখন বিভিন্ন নৃশংস সামরিক অভিযান পরিচালনা করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। কিংবদন্তিতুল্য হলেও কারও জীবনপঞ্জীতে এ ধরনের জনশ্রুতি মূল বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় নয়। ঐতিহাসিক বড়জোর একে জনশ্রুতি হিসেবে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের উপসংহারে জুড়ে দিতে পারেন। যাই হোক, বানানো গল্প দিয়ে কারও শক্তিমত্তার প্রমাণ করা ঐতিহাসিকের পক্ষে একটি গর্হিত কাজ। চেঙ্গিস খান সম্পর্কে রামপ্রাণ গুপ্ত প্রণীত ‘মোঙ্গল বংশ’ একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। কোথাও লেখা নেই যে চেঙ্গিস খান মুসলমান ছিলেন।
এবার দেখা যাক কবে থেকে মোঙ্গলরা মুসলমান। চেঙ্গিসের কোনো ছেলে মুসলমান ছিলেন বলে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। তার সন্তান-সন্তুতির সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচশ’। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারজন হচ্ছেন—প্রথম ছেলে জুজি খান। তিনি ছিলেন সাইবেরিয়ার শাসনকর্তা। চেঙ্গিসের মৃত্যুর আগেই মারা যান তিনি। মধ্য এশিয়ায় শাসনকর্তা ছিলেন দ্বিতীয় ছেলে চাগতাই খান। তৃতীয় ছেলে ওকতাই খান বাবার ইচ্ছানুসারে গোটা সাম্রাজ্যের নরপতি হন। তার প্রধান সেনানায়ক হন তৃতীয় ছেলে। জুজি খানের দুই ছেলে—বাঁতু খান ও তুলি খান। এই তুলি খানের ছেলেই ইতিহাসের কুখ্যাত বীর হালাকু খান। তার ভাই মঙ্গু খান এবং কুবলাই খানও ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র। এরা কেউ মুসলমান ছিলেন না। তবে দুই-একটি বহুল পঠিত ইতিহাসে বলা হয়েছে, মোঙ্গল খানদের মধ্যে হালাকু খানই প্রথম মুসলমান হন। সেকালের মশহুর তাপস খাজা আবু ইয়াকুব ও খাজা মোহাম্মদ দরবন্দীর অলৌকিক কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু History of the Arab’s গ্রন্থের প্রণেতা ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি লিখেছেন, হালাকুর মৃত্যুর পর মোঙ্গলদের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তার শবদেহের সঙ্গে একজন সুন্দরীকে সমাহিত করা হয়েছিল। এতে প্রমাণ হয় না যে, হালাকুর মুসলমান হওয়ার ঘটনা সঠিক নয়।
মোঙ্গলদের মুসলমান হওয়ার ঘটনা প্রথম ঘটে পারস্যে। হালাকুর ছেলে আবাকা খান ওমেসার যুদ্ধের পর (১২৮০ খ্রি.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অন্য ছেলে সেকুদার খান মুসলমান হয়ে সুলতান আহমদ নামে পরিচিত হন। আবাকার ছেলে আরগুন খান। তার ছেলে গাজান মাহুমদ ও মোহাম্মদ খোদাওয়ান্দ খান। খোদাওয়ান্দের ছেলে সঈদ খান।
মোঙ্গলরা মুসলমান হন এদেরই উদ্যোগে। পরবর্তীকালে তাদের বংশধররা মোঙ্গল, তাতার, কিরঘিজ তুর্কমান, কাজান, উজবেক ও কশাক জাতিকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে সমর্থ হয়। এই হচ্ছে মোঙ্গল ‘খান’দের মুসলমান হওয়ার ইতিহাস। কাজেই ধর্মান্তরিত মুসলমান মাত্রেই খান এবং খান মাত্রেই মুসলমান, এ তথ্য সঠিক নয়।

No comments

Powered by Blogger.