জোড়া হাতি রিমান্ডে by হাসান হাফিজ

হাতি হলো দুষ্টলোকের অপকর্মের সাথী। হাতি নিয়ে মাতামাতি যথেষ্টই হয়ে গেল। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় ঘটেছে এ ঘটনা। সংরক্ষিত বন এলাকায় রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে সাবাড় করছিল বনদস্যুরা। সেই কুকামে লাগানো হয় দুটি অবলা হাতিকে।
ধরা খেয়েছে পোষা হাতি দু’টি। একটি বড়। অন্যটি ছোট। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঘটেছে এ দুর্ঘটনা। হোতারা উধাও যথারীতি। ঘটনাস্থল জুড়ী-১ রেঞ্জের সাগরনাল বিট এলাকা। বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হাতিগুলোর শরীরের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা ছিল কাটা গাছ। একটি কাটা গাছও জব্দ করা হয়েছে। জুড়ী, কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলায় অনেক লোক পাহাড়ি এলাকা থেকে গাছ টানানোর কাজের জন্য হাতি পোষে। সংরক্ষিত বন থেকে অবৈধভাবে গাছ পাচারের কাজে লাগানো হয় ওদের। রাতপ্রতি ভাড়া পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা। বনদস্যুরা এই হাতি ভাড়া নেয়। মাহুতরাও লুকিয়ে চুরিয়ে ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নেয় টু পাইস ।
সংক্ষেপে এই হলো খবর। আমরা একটু ‘চিরুনি অভিযান’ চালিয়ে দেখতে পারি আটক হওয়ার পর মা ও বাচ্চা হাতির কী দশা হলো? লানত ও হয়রানির একটা চিত্র তাহলে পেতে পারি। এতকাল মানবসমাজের জন্যই রিমান্ড, চোখ বেঁধে অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়ন, হাজতবাস,বন্দুকযুদ্ধ, গুমখুনের ঘটনা ঘটত। এখন ব্যাপারটি আরও সর্বজনীনতা পেয়েছে। পশুর পর্যায়ে নেমে গেছে। নেমে গেছে না জাতে উঠেছে, সেই বিবেচনা মহাকালের।
বনরক্ষীরা ও পুলিশ পড়েছে মহাবিপদে। হাতিকে বাগ মানাতে গিয়ে তাদের গলদঘর্ম অবস্থা। এ দুর্দশা কহতব্য নয়। এত বিশালদেহী প্রাণীকে সামলানো কী চাট্টিখানি কথা? মা হাতির গলার দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান দিলে বাচ্চাটা যায় বিগড়ে। বিপরীতদিকে দৌড়ায়। বহু মেহনতের পর থানায় নেয়া হলো জোড়া হাতিকে। ওসি হাওরের বড় মাছ দিয়ে জম্পেশ খানাপিনা সেরেছেন মাত্র। পান সিগারেটের রসে-ধোঁয়ায় আরাম করছেন। উটকো আপদের আগমনে বিরক্ত হলেন যারপরনাই। ডিজিটাল ঝামেলা বোধহয় একেই বলে! একটু আয়েশ করার জো নেই। এমন চাকরির গুষ্টি কিলাই।
ওসি বিস্তারিত শুনলেন। কোন্ ধারায় এই পশু দু’টির বিরুদ্ধে মামলা নেবেন? জিডি হবে, না ফৌজদারি মামলা? এসব প্রশ্নের যুত্সই উত্তর খুঁজে পান না। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
মা হাতিটা এ সময় কথা কয়ে ওঠে। সে ভেবেছিল, এখানে তাদের টেনেহিঁচড়ে আনা হয়েছে অন্য কোনও বড় কাজে। হয়তো আরও ভারি মালামাল টানানো হবে। মিনমিন করে সে ওসিকে একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করে। মিনমিনানোর যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। প্রবাদে আছে, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। আগে বলতো, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশে দিনবদল হয়ে গেছে রাতারাতি। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারই এখন মিচকে বেড়াল। লোকালয়ে ঘরের চালায় উঠেও বাঁচতে পারছে না। বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে নির্মম গণধোলাইয়ে। হাতি ভাবে, এ দেশের মানুষরাই বাঘকে জাতীয় পশু হিসেবে সম্মান দিয়েছে। আবার তারাই কিনা খুঁচিয়ে ওদের মেরে ফেলছে একের পর এক। সুন্দরবন সাফা হয়ে যেতে আর বাকি নেই।
হাতি বলে,
—ওসি সাব, কী কাম দিবেন দ্যান।
বাজখাঁই কণ্ঠে ওসি বলেন,
—চোপ ব্যাটা। কাম কিসের? অকাম করছস বইলাই আনা হইছে তোদের। এখন বুঝবি কত ধানে কত চাল।
হাতির চোখ ছানাবড়া। ক্ষীণস্বরে প্রতিবাদের চেষ্টা করে,
—কন কী স্যার। আমাদের অপরাধটা কী?
ওসি গর্জন করে ওঠেন,
—মহামূল্যবান জাতীয় সম্পদের অপচয় করছিস তোরা। তোদের জন্যই বনবাদাড় উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। রিমান্ডে নিলেই বোঝবা বাপধন।
বাচ্চা হাতিটা এতক্ষণ অবাক হয়ে কাণ্ডকারখানা দেখছিল। সে তার মাকে জিগ্যেস করে,
—আচ্ছা মা, রিমান্ড কী? কেমন দেখতে? আমি তো দুধের শিশু। আমার কী ছাড় নেই?
মা হাতি শুঁড় দিয়ে সসস্ করে চুপ থাকবার নির্দেশ দেয় ছানাকে।
ওসি ঘড়ঘড়ে গলায় উত্তর দেন,
—রিমান্ড হইল বাঁশডলা, পা উল্টাইয়া ঝুলাইয়া রাখা, চউক্ষে কালা কাপড় বাইন্ধা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। বেশি তেড়িবেড়ি করলে ক্রসফায়ার!
বেবি এলিফ্যান্ট কৌতূহল প্রকাশ করে,
—অ্যাদ্দিন জানতাম গাছ টানার জন্য আমাদের অনেক ডিমান্ড। এখন উল্টা রিমান্ডে নিয়ে আসছে। এটা কেমন বিচার?
মা হাতি বলে,
—মানুষরা এরকমই, ভীষণ অকৃতজ্ঞ রে বাপ। পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নাম তারা পাল্টে রেখেছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেবে না। মানববন্ধন করবে না। টিভির কোনো টক শোতেও আলোচনা হবে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও থাকবে নিশ্চুপ। প্রাণী অধিকার নামে তো কোনো এনজিও নেই। ফান্ড পায় না তো, সেই জন্য। সুতরাং রিমান্ডে আমাদের হাড়গোড় ভেঙে দিলেও কিছু করার নেই।
hasanhafiz51@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.