মোহমুক্ত জীবন সাধনা by আতাউর রহমান

বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার নিয়ে যখন ভাবছিলাম এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিলাম, তখনই কীর্তিমান ভারতীয় সাংবাদিক এমজে আকবরের একটি প্রতিবেদন পড়ে যেন আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। কিছুদিন আগে আমাদের শ্রদ্ধেয় গুণী এক ব্যক্তির স্মরণ সভায় বক্তারা অনেকেই বলছিলেন যে, তার গুণগ্রাহী একাধিক ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছেন অথচ প্রয়াত এই গুণীজন রাষ্ট্রীয় সম্মান লাভ করেননি।
আমি সেদিন আমার বক্তৃতায় বলেছিলাম, এই রাষ্ট্রীয় অথবা আন্তর্জাতিক সম্মাননা অথবা স্বীকৃতি এক অর্থে অনেক কিছু, আবার অন্য অর্থে কিছুই নয়। প্রায় সব পুরস্কার ও সম্মাননার পেছনে দাতাদের নিজস্ব ভূমিকা থাকে, তাদের নিজস্ব মতাভিমত থাকে, যা সার্বজনীনভাবে গৃহীত নাও হতে পারে। অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের ভেদবুদ্ধিও কাজ করে। সুতরাং এসব বড় বড় পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তি সবসময় সঠিকভাবে প্রাপকের কপাল চুম্বন নাও করতে পারে। তাছাড়া আমি মনে করি, পুরস্কার বা সম্মাননা সত্যিকার বড় মানুষকে স্পর্শ করে না। কোনো কোনো মানুষ মানবিক আকৃতিতে এত বড় হন যে কোনো পুরস্কারের বেড়াজাল তাদের বাঁধতে পারে না। নোবেল পুরস্কার লিও তলস্তয়ের জীবদ্দশায় চালু হয়; কিন্তু তার মতো প্রতিভাবান ও সর্বজনগ্রাহ্য ঔপন্যাসিকও নোবেল পুরস্কার পাননি। এতে করে তলস্তয়ের প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার কোনো ঘাটতি হয়নি। একই ঘটনা ঘটেছে নরওয়ের নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের ক্ষেত্রে। তিনিও নোবেল পুরস্কার পাননি। এতে নাট্যকার হিসেবে ইবসেনের মহত্ব এতটুকু হ্রাস হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। আমি এবং আমার মতো অনেকেই মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার না পেলেও তার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না, তিনি বিশ্বকবি ও বিশ্বমানব রবীন্দ্রনাথই থেকে যেতেন। এভাবে অনেক আন্তর্জাতিক বড় পুরস্কার এবং রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে নানা ধরনের ভেদবুদ্ধি, বিবেচনা, এমনকি রাজনীতির খেলাও চলে। তবে আমরা যারা রিপুজয়ী মানুষ হতে পারিনি তাদের জন্য যে কোনো পুরস্কারই আনন্দ সংবাদ বয়ে আনে। পুরস্কার তো প্রধানত কাজেরই উচ্চারিত স্বীকৃতি, কারও ভাগ্যে জোটে, কারও ভাগ্যে জোটে না। ভারতের স্বাধীনতা ও রাজনীতিতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার বিখ্যাত বই ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ অনেকেই পড়েছেন। তার মতো নীতিবান ও সত্যনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ সারা বিশ্বে বিরল। এই অসাম্প্রদায়িক অথচ ধার্মিক মানুষটি স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৫৮ সালে তিনি ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেই প্রয়াত হন। প্রথম যখন ‘পদ্ম’ অভিধাযুক্ত (পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ইত্যাদি) রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ভারতে প্রবর্তিত হয় তখন পণ্ডিত নেহরু মৌলানা আজাদকে উচ্চমানের ‘পদ্ম’-সংযুক্ত একটি পুরস্কারে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন। মৌলানা আজাদ বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিলেন এই বলে যে, দেশের সরকার কি ভাবে সরকারকে পুরস্কৃত করবে? তিনি যে সরকারেরই অংশ। মৌলানা আজাদ সারা জীবনে কখনও রাজনৈতিক ফিতা দিয়ে নিজেকে মাপেননি। তিনি ছিলেন সত্যিকার একজন দেশপ্রেমিক ও জাতীয়বাদী ভারতীয় নেতা। তার বৈদগ্ধ বিচার করতে গিয়ে একবার সরোজিনী নাইডু মজা করে বলেছিলেন, মৌলানা আজাদ যেদিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেদিনই তিনি ৫০ বছর বয়সে উপনীত হয়েছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে মৌলানা আজাদ উর্দুতে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যার ভগ্নাংশের অর্থ হলো, ‘চেয়ে দেখ আজাদ, এই অস্থির চিত্তগুলো কেমন আর্তনাদে আকাশ-পাতাল নিলদিত করছে। প্রশ্নগুলো পাতাল থেকে উত্সারিত এবং উত্তরগুলোর ঠিকানা উন্মুক্ত আকাশে বিরাজিত।’ নির্মোহ এই মহা-মানুষটিকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিয়ে এভাবে অনেক মজার মজার গল্প ও কাহিনী প্রচলিত আছে। ডিজি টেন্ডুলকার নামে এক লেখক ৯টি বড়সড় আকারের বই লিখেছেন মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে, যাকে জীবনী গ্রন্থ বলা চলে। এই বইগুলো মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা হলেও এই গ্রন্থগুলো আধুনিক ভারতের ইতিহাসের ওপর ধ্রুপদী রচনা হিসেবেও গণ্য করা যায়। এই বইগুলো এখন বাজারে নেই। প্রকাশক বইগুলো পুনর্মুদ্রণ করেননি। টেন্ডুলকার খুব সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। মুম্বাই শহরে সময় কাটত উচ্চবংশ জাতীয় সারমেয়কে নিয়ে নয়, বলা যায় রাস্তায় মালিকবিহীন এক কুকুরকে নিয়ে। এই আত্মগোপনকারী লেখককে ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দেয়ার বাসনা প্রকাশ করে। তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। টেন্ডুলকার রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখে তাকে জানালেন, তার একটি হাতঘড়ির বড়ই প্রয়োজন, সুতরাং তাকে পুরস্কারের পরিবর্তে একটি হাতঘড়ি দান করলে বেশি উপকার হয়। সরকারের কাছ থেকে একটি কাগজে ছাপানো সার্টিফিকেট পেয়ে তার কী লাভ হবে! ভারত সরকার এই লেখককে ঘড়ি এবং ‘পদ্মভূষণ’ দুটোই দিয়েছিল। এই কাহিনী শোনালাম এজন্য যে, আসলে মানুষ জীবনের প্রাপ্তিগুলোকে কীভাবে দেখে, তার ওপর নির্ভর করে তার পার্থিব জীবনের সুখ-শান্তির মাপকাঠি। আমার মনে হয় আমাদের সীমাহীন লোভ, আকাঙ্ক্ষা, অলীক স্বপ্ন আমাদের জীবনের শান্তিকে অনেকাংশে নষ্ট করে। এজন্য জীবনে শান্তি লাভের সর্বোত্তম পথ হলো ‘নির্মোহ’ জীবনযাপন করা যা সাধন করা প্রায় অনেকেরই পক্ষে দুঃসাধ্য। বিত্ত ও ক্ষমতার মোহ মানুষকে ধ্বংস করে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় তারই কাহিনী আমরা পড়েছি এবং এখনও পড়ি। আমরা নির্মোহ না হলেও নির্লোভ হওয়ার চেষ্টা করতে পারি; নিজের সুখের জন্য এবং সমাজ ও দেশের মঙ্গলের জন্য।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.