অবৈধ বিদেশযাত্রা ঠেকাতে বিমানবন্দরে চোখ রাখবে 'ভিজিল্যান্স টিম' by আবুল কাশেম

রাজধানীর ফকিরাপুলে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা! এক শ্রেণীর ট্রাভেল এজেন্সি এসব জাল ভিসা দিয়ে গ্রামের যুবকদের বিদেশে পাঠানোর ফাঁদ পাতছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্বরত ১৭টি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে হাত করেই বিদেশগামী বিমানে উঠছেন এসব যুবক।


সংস্থাগুলোর সঙ্গে দালালচক্রের নিবিড় বোঝাপড়া রয়েছে। দেশের বিমানবন্দর নিরাপদে পার হওয়া গেলেও অবৈধ ও জাল ভিসা নিয়ে বিদেশের বিমানবন্দরে পৌঁছে ধরা পড়ছেন তাঁরা। গ্রেপ্তার, নির্যাতনের পর সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসছেন দেশে। সফল হওয়ার আশায় বারবারই চলে বিদেশ যাওয়ার এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এসব কর্মকাণ্ডে দেশের দুর্নামের পাশাপাশি রুদ্ধ হচ্ছে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সীমিত সুযোগও। ইউরোপ ছাড়াও আফ্রিকা ও এশিয়ার সম্পদশালী কয়েকটি দেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব অপকর্মের তথ্য জানেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মন্ত্রী ও সচিবরাও। এ প্রক্রিয়ায় বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের আর্থিক ক্ষতি ও জীবনের ঝুঁকি ছাড়াও দেশের সুনামের প্রশ্ন জড়িত থাকায় এ ব্যাপারে সরকার সক্রিয় হচ্ছে। অন্তত বিমানবন্দর দিয়ে যাতে অবৈধভাবে কাউকে বিদেশে পাঠানো না যায়, সেজন্য ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তমন্ত্রণালয় 'পরিদর্শন দল' গঠন করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, দালালদের কাছে টাকা দিয়ে দরিদ্ররা এভাবে প্রতারিত হচ্ছে। দালালরা প্রতারক ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে মিলে এ কাজ করছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ এখনো দালালদের কাছেই যাচ্ছে। অথচ বিদেশে পাঠানোর কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আতাহারুল ইসলাম জানান, ভুয়া ভিসায় যাওয়া সাত বাংলাদেশী মালদ্বীপের বিমানবন্দরে আটক রয়েছেন। তাঁদের ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিমান মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। কিন্তু আটক শ্রমিকদের ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাঁরা কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যাননি। কোনো ট্রাভেল এজেন্সি নিজেরাই জাল ভিসা তৈরি করে তাঁদের পাঠিয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাজমা বেগম বলেন, ২৪ এপ্রিল লিবিয়ার বিমানবন্দরেও ৭৭ বাংলাদেশি আটক হয়েছে। লিবিয়া থেকে ফেরত আসা শ্রমিকদের দেশটি নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। এই সুযোগে প্রতারক ট্রাভেল এজেন্সিগুলো লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের তৈরি করা জাল ভিসায় অবৈধভাবে লোক পাঠাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দরে ১৭টি সরকারি সংস্থা নিয়োজিত রয়েছে। এদের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে। প্রতারক ট্রাভেল এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে জাল ভিসা দিয়ে শ্রমিকদের বিমানবন্দর পার করে দিচ্ছে।
রাজধানীর ফকিরেরপুলে বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা তৈরির 'ওপেন সিক্রেট' কাজটি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জানা। তাঁরা বলেন, 'অপেক্ষাকৃত দুর্বল আইন রয়েছে- এমন দেশে অবৈধভাবে গিয়ে কেউ কেউ বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে কাজ করার সুযোগ পায়। অন্যরা জেলখেটে দেশে ফিরে আসে। জাল ভিসায় অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠানোর কারণেই মালয়েশিয়ার বাজার আমাদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।'
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জানান, বিমানবন্দর দিয়ে যাতে আর অবৈধভাবে জাল ভিসায় কেউ বিদেশ যেতে না পারে সেজন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এক বৈঠকের পর পরিদর্শন কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। অননুমোদিত বিদেশযাত্রা বন্ধে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানো বন্ধে গত ৮ ফেব্রুয়ারি এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। সেখানে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশীদের অবৈধভাবে বিদেশে গমন বা বিদেশে গিয়ে অবৈধভাবে কাজে নিয়োজিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে অভিবাসী কর্মী গ্রহণকারী দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কর্মী নেওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসন নিশ্চিত করতে না পারলে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। এজন্য অবৈধভাবে বিশেষ করে অভিবাসী কর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য কেউ যাতে ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশে যেতে না পারে সেজন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের ভিজিল্যান্স টাস্কফোর্সের সভাপতি বলেন, কতিপয় অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশীদের বিদেশে কাজের কথা বলে পাঠাচ্ছে। সহজ-সরল লোকজন তাদের ভিসার ধরন না বুঝে বিদেশে গিয়ে কাজে নিয়োজিত হওয়ার চেষ্টা করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। ওইসব দেশ এ ধরনের শ্রমিকদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। ট্রাভেল এজেন্সিগুলো এমনসব লোককে ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশে পাঠাচ্ছে, যাঁরা অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় কোনোমতেই ট্যুরিস্ট হওয়ার যোগ্য নন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বৈঠকে জানান, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য এ দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালচক্র নিয়োগকারী কম্পানির কর্মকর্তা ও মালিকদের অবৈধভাবে ম্যানেজ করে থাকে। অবৈধভাবে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি ও ট্রাভেল এজেন্সিকে দায়ী করে তিনি বলেন, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বিমানবন্দরে কড়াকড়িভাবে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া রোধ করা সম্ভব হবে।
জাল ভিসা ও ট্যুরিস্ট ভিসায় যাতে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানো বন্ধ করা যায়, সেজন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. শাফায়াত হোসেনকে প্রধান করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট পরিদর্শন দল শিগগিরই কাজ শুরু করবে। এ দলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, পুলিশের বিশেষ শাখার একজন ডিসি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বিএমইডি, র‌্যাব, বিজিবি (বিডিআর), স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কোস্টগার্ড, আইওএম ও এটাব'র প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।
পরিদর্শন দলের প্রধান শাফায়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, ২৫ এপ্রিল থেকেই কাজ শুরু করতে চেয়েছিলাম। তবে হরতালের কারণে তা সম্ভব হয়নি। শিগগিরই পরিদর্শন দল কাজ শুরু করবে। এতে অবৈধভাবে বিদেশে লোক পাঠানো বন্ধ হবে বলে আশা করি।

No comments

Powered by Blogger.