অর্থনীতি-মধ্যবিত্তের বিকাশ কেন জরুরি by আবু আহমেদ

আমাদের এক সাহিত্যের অধ্যাপক একদিন আমাকে প্রায় পাকড়াও করার অবস্থা। অবশ্য শারীরিকভাবে নয়, কথার মাধ্যমে। ওনার কথা হলো, আমরা যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাচ্ছি, তাতে গরিব কৃষক ও ভূমিহীন লোকদের কোনো উপকার হবে না।


আমাদের নীতিতে শুধু শহরের লোকেরাই আরও বড়লোক হবে। তিনি এও বললেন, কৃষির সঙ্গে আমাদের অধিকাংশ লোকের জীবিকা আজও সম্পর্কিত। তাই কৃষির উন্নতি না হলে দেশেরও উন্নতি হবে না। এসব কথা শুনে আমি বুঝলাম, উনি সাহিত্যের লোক হলে কী হবে, সমাজ পরিবর্তন নিয়ে মাথা ঘামান। এবং সেদিন আমি ওনাকে কথা দিয়েছিলাম, ওনার এসব নিয়ে আমি একদিন লিখব। আমি ওনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে মধ্যবিত্তের বিকাশ না হলে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হবে না। আর বিনিয়োগ না হলে আমাদের উত্পাদন বাড়বে না, কর্মসংস্থান হবে না, আমরা কৃষি নিয়েও আগের দরিদ্র অবস্থায় থেকে যাব। অতিদরিদ্র লোকেরা উদ্বৃত্তের অভাবে বিনিয়োগ করতে পারে না। সে জন্য সব বাজার অর্থনীতিতেই একটা শ্রেণীকে উত্সাহ দিয়ে গড়ে তোলা হয়, যারা নিজ স্বার্থেই বিনিয়োগের ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসবে। আপনি যদি বাজার অর্থনীতির মৌলিক নীতিগুলোকে মানতে চান, তাহলে বাজারের পথ ধরেই মধ্যবিত্তের বিকাশকে মেনে নিতে হবে। উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী কি কৃষিতে বিনিয়োগ করবে, না সেবা ও শিল্পে বিনিয়োগ করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। এখানে তাদের বেশি দিকনির্দেশনা দিতে গেলে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নাও হতে পারে। আবার দেখুন, বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী যদি শুধু কৃষিতে বিনিয়োগ করে, তা হলে কৃষিজমির মূল্য বেড়ে যাবে এবং দরিদ্র লোকেরা আরও দ্রুত হারে ভূমিহীন হতে থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রেও ভালো বিকল্প হলো কৃষিকে শুধু শস্য ও ধান-পাট উত্পাদনের জন্য ব্যবহার না করে বরং কৃষির উপকার হয় বা কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করা।
তা হলে কৃষিকে কেন্দ্র করেও একটা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠবে, যাদের ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে শহরের উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। আমি ওনাকে এও বললাম, আজকের দিনে অর্থনীতিতে কৃষি, শিল্প ওইভাবে দ্বিভাজন করা হয় না। আজকে কৃষি, শিল্প, সেবা সবই এক অর্থে শিল্প, আমরা একসঙ্গে বলতে পারি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কৃষি, শিল্পকে আগে যেভাবে বিভাজন করা হতো, এখন আর তা করা হয় না। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা করলে বরং কৃষিরই ক্ষতি হবে। আর আপনি বলছেন, ঘরপ্রতি সাহায্য ও মাইক্রো ক্রেডিট দিয়ে দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমানো যাবে না। সেটা আমিও জানি। আমি যেটা চাই, সেটা হলো উচ্চ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দরিদ্র লোকদের দ্রুত প্রধান অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করা। আর একটা কথা তো আমরা কেউ বলছি না, সেটা হলো আমাদের বর্ধিত জনসংখ্যাজনিত সমস্যা। আমাদের জন্য আবশ্যিক হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির দৌড় থামানো। তাহলে সে কাজটা কেন আমাদের সরকার মনোযোগ দিয়ে দেখছে না। আজকে কৃষিজমি বছরে এক শতাংশ করে কমছে। সামনে মোট কৃষিজমি যখন কমে যাবে, তখন আরও বেশি হারে ওই জমি কমবে। তাহলে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার ব্যাপারটি কী হবে, একবার ভাবুন। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৭ বছরে আমরা তো সংখ্যার হিসাবে দরিদ্র লোকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু তার পরও মোটের হিসাবে দরিদ্র লোকদের সংখ্যা স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতে যেখানে ছিল, আজও সেখানে আছে। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে আমরা যদি ১০ কোটিতে আটকে রাখতে পারতাম, তাহলে গড়ের হিসাবে আজই বাংলাদেশ একটা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিগণিত হতো। আর আজকে ১৫ কোটি লোক নিয়ে এবং সামনের বাড়তি হিসাব ধরে বর্তমান প্রবৃদ্ধির হারে এই অর্থনীতি মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হতে আরও চার যুগ সময় লাগবে। তাহলে সমস্যাটা যেদিক দিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, সেদিকে আমরা মনোযোগ দিচ্ছি না।
সে ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের বাজেটের বড়ই অভাব। আর একটা কথা আপনাকে বলি, পশ্চিমের কথিত ডোনার এজেন্সি থেকে অর্থ না পেলে কোনো নামীদামি এনজিও এ ক্ষেত্রে কোনো রকম চিত্কার দেবে না। বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করেছে দুটো দিক দিয়ে, এক হলো বিশ্বের জন্য কাপড় কাটা ও সেলাইয়ের কাজ করার জন্য, অন্যটা হলো শ্রম রপ্তানির জন্য। প্রথমটাকে আমরা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলেও শুধু শ্রমিক রপ্তানির দেশ হয়ে আমাদের পরিচিতি ঘটবে, সেটা কি আপনার-আমার জন্য সুখকর? আপনি বলছেন, কৃষকের দারিদ্র্য মোচানোর জন্য বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা মোটেই টেকসই নয়। আমিও সে রকমই মনে করি। তবে আমি ভাবি, এবং সে সঙ্গে বলিও যে কৃষকদের সাহায্য করার ভালো উপায় হলো তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নিখরচায় মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। আমরা কি শুধু কৃষক এবং দরিদ্র লোকদের ছেলেমেয়েদের জন্য সরকারি অর্থে এক লাখ বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারি না? আমাদের সবার মনে থাকার কথা, স্বাধীনতা পূর্বকালে গরিব ও মেধাবী ছাত্ররা যে মাসিক বৃত্তি পেত, তাতে তাদের মাসের পূর্ণ খরচ চলে যেত। আজকে বৃত্তি কমেছে ছাত্রের সংখ্যার তুলনায়, বৃত্তির অর্থও কমেছে; যদি অর্থের ক্রয়ক্ষমতা দ্বারা হিসাব করা হয়। অন্য অনেক দেশ বছরে শত শত বৃত্তি দিয়ে তাদের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিদেশেও পড়তে পাঠাচ্ছে। অনেকেই বলেন এবং আমিও শর্তসাপেক্ষে বলি, আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যাই আমাদের আসল সম্পদ। কিন্তু এই জনসংখ্যাকে আরও উত্পাদনশীল করা যায় শুধু উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে। সেই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। বেসরকারি খাত আপাতত গরিবের ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় পড়াতে এগিয়ে আসবে না। খয়রাতি সাহায্যের চেয়ে বড় উপকার হবে, যদি দরিদ্র লোকের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে দেওয়া যায়। আমি আমার জুনিয়র সহকর্মীকে এও বললাম, মধ্যবিত্তের বিকাশ ছাড়া শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগের বিষয়টা ঘটবে না। এই প্রক্রিয়ায় আয়ের বণ্টন কথিত পুঁজিপতিদের পক্ষে চলে যাবে। এবং সমাজ সেটা সহ্য করে নেয় বৃহত্তর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। এর বিকল্প কি আছে? আছে, সরকারের উদ্যোগে যাবতীয় অথবা সিংহ ভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমাধা করা। আপনি কি সেটা চান? সেটা হতে গেলে অর্থনীতি শুধু অধোগতির পথেই যাবে, যার প্রমাণ অতি নিকট অতীতে আমরা আমাদের অর্থনীতিতেই দেখতে পেয়েছি।
আমরা অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমাদের অর্থনীতিকে বাজারমুখী করেছি। এই অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতই প্রধান চালিকাশক্তির কাজ করবে। সরকার সুবিধা ও সহযোগিতা দেবে। আর আপাতত যেখানে ব্যক্তি খাত কাজ করতে চাইবে না, সেখানে সরকার নিজে উত্পাদন ও সেবা প্রদানের কাজগুলো চালিয়ে যাবে। তবে সত্য হলো, অন্য দেশে সরকারি খাত ভালো কাজ করলেও আমাদের দেশে এই খাত ভালো করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এটা তো আপনারা সবাই চোখের সামনে দেখছেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষাতে। যে পরিমাণ অর্থ এই দুটো খাতে অপচয় ও চুরি হচ্ছে, তা দূরের লোকদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। বাজার অর্থনীতি আমি চাচ্ছি, তবে সেই অর্থনীতি হতে হবে রেগুলেটেড। রেগুলেশনে ত্রুটি থাকলে ওই অর্থনীতিতে দুর্নীতি হবেই এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশীদারেরা মার খাবেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমাদের রেগুলেশন বড়ই দুর্বল, স্বাস্থ্য খাতে এটা নেই বললেই চলে। তাই তো পথেঘাটে এত রোগ নির্ণয়কেন্দ্র দেখেন এবং পরীক্ষার নামে শুধুই রোগীদের পকেট কাটা হচ্ছে। আমার এক সহকর্মী আছেন, তিনি পারতপক্ষে ডাক্তারের কাছে যান না। তিনি বলেন, ডাক্তার মানে বেশি ওষুধ, বেশি পরীক্ষা, শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের বেডে ওঠা। ওনার এই ধারণা বা অভিজ্ঞতা কেন হলো? ওই সেই রেগুলেশনের অভাব থেকে। এ ক্ষেত্রেও একটা রেগুলেটরি কমিশন করা যেত। কিন্তু আজ সব ওষুধ কোম্পানি, ডাক্তারদের চিকিত্সাসেবা এবং রোগ পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোকে আমরা ডিরেক্টর অব হেলথের ওপর ছেড়ে দিয়েছি, যেই সংস্থা আজকের দিনে এ কাজগুলো করার জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। আমাদের বাজার অর্থনীতিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটছে। তবে এই বিকাশটা চীন-ভারতের তুলনায় অনেক ধীরে হচ্ছে। এমনকি আমাদের মধ্যবিত্তের লোকেরাও পশ্চিমের অনেক দেশের পরিমাপে এখনো দরিদ্রই। তবে গত দুই যুগে অর্থনীতিতে একটা ভোক্তা শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। যারা একদিকে ভোগ করছে, অন্যদিকে উদ্যোগেরও দায়িত্ব নিচ্ছে। এদের উত্থানের পেছনে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা অবশ্যই কাজ করেছে। এরা যেভাবেই অর্থের মালিক হোক না কেন, এদের উদ্যোগে এখন ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্ প্লান্ট হচ্ছে। এক হাজার কোটি টাকার কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস স্থাপিত হচ্ছে। এরা আকাশপথের যানবাহন উড়োজাহাজ কোম্পানিরও মালিক হচ্ছে। তবে সম্পদের কেন্দ্রীভূত অবস্থা নিয়ে আপনার মতো আমিও উত্কণ্ঠিত। বাজার অর্থনীতি সব সময় আর্থিকভাবে সবল লোকদের পক্ষে কাজ করে। আমি শেয়ারবাজারের মাধ্যমে আমাদের নিম্ন ও উচ্চমধ্যবিত্ত লোকদের সম্পদের মালিকানা দিতে বলি। এটা ওই অনুভূতি থেকেই বলি, যাতে আমাদের মধ্যবিত্তের লোকেরা মালিকানার মাধ্যমে সংখ্যার দিক দিয়ে আরও প্রসারতা লাভ করে। সবচেয়ে বড় অবিচার তো হলো লোকদের উদ্যোগ ও মালিকানা থেকে দূরে রাখা। আজকে অনেকটা পলিসি মেকারসদের অগোচরে হলেও আমাদের শেয়ারবাজারটা এগিয়েছে অনেক। বড় প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য এই বাজারের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। ২৬ লাখ মধ্যবিত্ত ঘরের লোকজন এই বাজারের সঙ্গে বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্ত হয়ে যে চাহিদাটা সৃষ্টি করেছে বা পুঁজির জোগান দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, সেটাকে আমাদের ব্যক্তি এবং সরকারি খাতে কাজে লাগানো হবে বলে আশা করি। শেয়ারবাজারকে ঘিরে একটা স্পেকুলেটিভ বিনিয়োগের বড় জোগান সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে পারলে অবশ্যই আমাদের অর্থনীতি ছয় শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। চীন-ভারতও ঠিক এই পথেই উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথে উত্তরিত হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে মুনাফা করার সুযোগটা যতই বাড়বে, ততই আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা আরও বেশি পুঁজি নিয়ে এগিয়ে আসবে। তখন কি আমাদের অর্থনীতিতে সত্যি পুঁজির অভাব থাকবে? সত্য হলো, আমাদের অর্থনীতিতে পুঁজির অভাব নেই। এই অভাবটা ছিল এক দশক আগে। বর্তমানে আমাদের সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। এটাও ভাবার বিষয়। দেশের ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রা পড়ে আছে। ব্যাংকে তরল অর্থ আছে। শেয়ারবাজারে পুঁজির জোগান বেশি হওয়ায় শেয়ার অতিমূল্যায়িত। এ অবস্থায় সরকারের এক অংশ যদি বিদেশে ছোটে বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য, অন্য অংশ বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে উঁচু সুদে ঋণ করার জন্য বেশি আগ্রহ দেখায়, তাহলে বিষয়গুলোকে জুতসই ব্যবস্থা বলে সমর্থন করা সত্যিই মুশকিল।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.