চিরুনি অভিযানঃ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা এবং মাফলার পরা সাত-আটজন by শাহ আহমদ রেজা

আওয়ামী লীগ সরকার হঠাত্ ইসলামী ছাত্রশিবির ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা শুধু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের লাশ ও কবর নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ভাষণ-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছেন না, তারা লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী সুদূর কুয়েত থেকে হুকুম পাঠানোর পরমুহূর্তে দৃশ্যপটে এসেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবার মন্ত্রী সাহারা খাতুনকে টেক্কা দিয়েছেন, হেলিকপ্টারে উড়ে চলে গেছেন রাজশাহীতে। ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনের হত্যাসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কিত তদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করারও প্রয়োজন বোধ করেননি শামসুল হক টুকু। তিনি সরাসরি ইসলামী ছাত্রশিবিরের দিকে আঙুল তুলেছেন এবং শিবিরকে ‘নির্মূল ও উত্খাত’ করার নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, দেশের যেখানে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিবিরের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে সেখানেই শিবিরকে ‘নির্মূল ও উত্খাত’ করার হুকুম দিয়েছেন তিনি। তার হুকুমে শুরু হয়েছে ‘চিরুনি অভিযান’! গ্রেফতার করা হচ্ছে শয়ের হিসেবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও কলেজের হোস্টেল থেকে তো বটেই, রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর ও নগরীর মেস ও বাসাবাড়ি এবং গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত হামলা চালানো হচ্ছে। বাদ পড়ছেন না জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরাও। হত্যারও শিকার হচ্ছেন শিবির কর্মীরা। এরই মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে একজন এবং চট্টগ্রামে একজন শিবির কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ ছাত্রশিবির কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। আইনসম্মতভাবে তত্পর এ ছাত্র সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাও হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে, ১৯৭৭ সালে।
শিবিরের বিরুদ্ধে এই মারমুখী কর্মকাণ্ড শুধু নয়, ছাত্রলীগের প্রতি সরকারের মনোভাবও মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দৈনিক প্রথম আলোর ভাষায় ‘প্রতিপক্ষহীন’ ছাত্রলীগ সারাদেশে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল (৮ ফেব্রুয়ারির সম্পাদকীয়)। ভর্তি বাণিজ্যেও ছাত্রলীগ রেকর্ডের পর রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, নষ্ট করেছে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জের ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাসের শেলের আঘাতে ২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু ঘটে মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিকের। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল যে, সরকার সমর্থক দৈনিকগুলোও ‘ছাত্রলীগকে সামলান’ শিরোনামে প্রধানমন্ত্রীকে তাগিদ না দিয়ে পারেনি। টেলিভিশনের টকশোতেও ছাত্রলীগের অপকর্মই প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সরকারের এতদিন টনক নড়েনি। এমনকি ছাত্রদল কর্মীর মৃত্যুর পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন নিষ্ঠুর মানসিকতার পরিচয় দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, এটা একটা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, ‘এমনটা ঘটতেই পারে’ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিকই’ রয়েছে! সে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীর মৃত্যুতে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন। অর্থাত্ অন্য কোনো সংগঠনের কর্মী বা সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে ক্ষমতাসীনদের কিছু যায়-আসে না। তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায় শুধু ছাত্রলীগের কেউ মারা গেলে। এ যে শুধু কথার কথা নয়, বাস্তবেও তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারুক হত্যাকে কারণ হিসেবে সামনে আনা হলেও সরকারের হঠাত্ এতটা নিষ্ঠুরভাবে তেড়ে ওঠার পেছনে অন্য একটি কারণ রয়েছে। সেটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফর। এই সফরের সময় ভারতকে অনেক কিছুই দিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের স্বার্থে এটা-ওটা অর্জনের বাগাড়ম্বর শোনা গেলেও বাস্তবে তেমন চেষ্টাই করেননি প্রধানমন্ত্রী। তার ব্যস্ততা ছিল শুধু ভারতকে দিয়ে আসার জন্য। দিয়েও এসেছেন তিনি ভারতের ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুসারে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের শুধু নয়, ভারতকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়কপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগ-সুবিধাও দিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভারত এখন থেকে আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে। এখন কলকাতা ও আগরতলার দূরত্ব ১৫০০ কিলোমিটারের স্থলে কমে হবে ৩৫০ কিলোমিটার। বড় কথা, এর ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে মারাত্মকভাবে। মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির আড়ালে প্রধানমন্ত্রী ভারতকে বাংলাদেশের জাতীয় বিদ্যুত্ গ্রিডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও সুযোগ দিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় বিদ্যুত্ গ্রিড ব্যবহার করে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বিদ্যুত্ নিয়ে যাবে—যা এতদিন সম্ভব হচ্ছিল না। অন্যদিকে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভারতের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। ভারত চাইলে যে কোনো সময় বাংলাদেশে বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ করতে পারবে, বাংলাদেশের করার কিছুই থাকবে না। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মতো অন্য কোনো বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বার্থে ভূমিকা রাখেননি। শেখ হাসিনা উল্টো এমন এক ‘সীমান্ত হাট’ চালু করতে সম্মতি দিয়ে এসেছেন, যে হাট শুরু হলে ভারতীয় পণ্যের দাপটে বাংলাদেশী পণ্য বাজার হারাবে, বাংলাদেশের শিল্প-কারখানার বিনাশ ঘটবে এবং বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। ভারতীয় পণ্যও কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়েই কিনতে হবে।
অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রী ভারতকে সব বিষয়ে শুধু দিয়েই আসেননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং শিল্প-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির জন্যও হুমকির সৃষ্টি করে এসেছেন। একই কারণে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে, সম্পাদিত সব চুক্তি ও যুক্ত ঘোষণাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। দলগুলো একই সঙ্গে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছিল। ঠিক তখনই সরকার নিয়েছে আগে আক্রমণের কৌশল। ধারণা করা হচ্ছে, নির্দেশনা এসেছে ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে। একটি উদাহরণ হিসেবে ভারতের অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক বি. রমনের কিছু কথার উল্লেখ করা যায়। সাবেক এই আমলা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একজন শীর্ষ উপদেষ্টা হিসেবেও পরিচিত। ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে, ৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারের ভাষণে বি. রমন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে আওয়ামী লীগ সরকার এবং বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থবিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বি. রমন বলেছেন, চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের পথে বিএনপি ও জামায়াত প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। বি. রমনের মতে, নির্বাচনে ভোটারদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়লেও দল দুটির রাজপথে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়নি। সুতরাং ভারতের স্বার্থে প্রথমে এমন ব্যবস্থা নেয়া দরকার যাতে বিএনপি ও জামায়াতের আন্দোলনের শক্তি অবশিষ্ট না থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগ সরকারও বি. রমনদের প্রেসক্রিপশন অনুসারেই তত্পর হয়ে উঠেছে। এজন্যই সরাসরি প্রতিপক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও শিবিরকে টার্গেট করেছে সরকার। এর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য যে জামায়াত ও বিএনপিসহ দেশপ্রেমিক দলগুলোকে ‘শায়েস্তা’ করা এবং তাদের আন্দোলনের ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়া—সে কথাও গোপন রাখা হচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতকে সবকিছু বাধাহীনভাবে দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকার এরপর পর্যায়ক্রমে বিএনপি ও ছাত্রদলকেও দেখে নেবে। ভারতকে দিয়ে আসার বিষয়টি যাতে জনগণের চোখে না পড়ে সেটাই চাচ্ছে সরকার।
ঘটনাপ্রবাহে অন্য কিছু আশঙ্কাজনক তথ্যও প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। এরকম একটি তথ্য হলো, বিদেশি কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা নাকি শিবিরসহ দেশপ্রেমিকদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে অংশ নিচ্ছে। তথ্যটিতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ হলো, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের যে শোচনীয় ভরাডুবি ঘটবে সেকথা বিদেশি কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাই আগে জানতে পেরেছিল। অভিযোগ রয়েছে, এসব সংস্থার পরামর্শেই শুরু হয়েছিল লগি-বৈঠার ভয়ঙ্কর তাণ্ডব। সে তাণ্ডবে, বিশেষ করে পল্টনের হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাদের মদত ছিলো বলে মনে করেন অনেকে। সে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই এবার আওয়ামী লীগের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ শুধু নয়, ইসরাইলের ‘মোসাদ’ও বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে তত্পরতা চালাচ্ছে।
এখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকেন্দ্রিক কিছু তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে (নয়া দিগন্ত, ১৬ ফেব্রুয়ারি), শাহ মখদুম হলের প্রভোস্ট ড. দুলাল চন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার রাতে সাড়ে ১২টার দিকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের একটি গ্রুপকে টিভি রুমে অবস্থান করার অনুমতি দিয়ে যান। প্রশ্ন উঠেছে, নিয়ম যেখানে ১২টার সময় টিভি রুম বন্ধ করা সেখানে প্রভোস্ট কেন সাড়ে ১২টার পরও ছাত্রলীগের ওই গ্রুপকে টিভি রুমে অবস্থান করার অনুমতি দিয়েছিলেন? শুধু তা-ই নয়, পুলিশকেও তিনি ছাত্রলীগের গ্রুপটিকে ‘দেখভাল’ করার অনুরোধ করেছিলেন।
দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, প্রভোস্ট বেরিয়ে যাওয়ার পরপর মাথায় মাফলার পরা সাত-আটজনের একটি গ্রুপ হঠাত্ শাহ মখদুম হলের গেটে এসে হাজির হয়েছিল। গেটের নিয়ন্ত্রণও তারাই নিয়েছিল। তাদের ভয়ে দুই নিরাপত্তা কর্মী পালিয়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে—মাফলার পরা এই সাত-আটজন আসলে কারা? প্রশ্নের কারণ, নিরাপত্তা কর্মীরাও এর আগে কখনও তাদের দেখেনি। জানা গেছে, এ গ্রুপটি হল গেটের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার কিছুক্ষণ পরই টিভি রুম থেকে হঠাত্ ‘মাগো’, ‘বাবারে’ এবং ‘বাঁচাও’ ধরনের চিত্কার শোনা গেছে। পরে শোনানো হয়েছে ফারুকের মৃত্যুর খবর। সংশয়ের কারণ হলো, সিট দখল নিয়ে গোলমাল হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হলে। ফারুক তাহলে কেন শাহ মখদুম হলে গিয়ে নিহত হয়েছে? ফারুকই কি তাহলে ‘মাগো’, ‘বাবারে’ এবং ‘বাঁচাও’ বলে চিত্কার করে উঠেছিল?
তৃতীয় তথ্য হিসেবে এসেছে ম্যানহোলে লাশ পাওয়ার রহস্য। কারণ, নবাব আবদুল লতিফ হল, সৈয়দ আমীর আলী হল এবং শাহ মখদুম হলের অবস্থান মুখোমুখি। রাত সাড়ে ৩টায়ও সেখানে ছাত্রলীগ কর্মীদের পুলিশের গাড়িতে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। পুলিশের পাশাপাশি তত্পর দেখা গেছে মাফলার পরা ওই সাত-আটজনকেও। এমন এক অবস্থায় ধাওয়ার মুখে পালাতে ব্যস্ত শিবিরের কারও পক্ষে লাশ টেনে নিয়ে যেতে পারার প্রশ্ন উঠতে পারে না। তাছাড়া অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সৈয়দ আমীর আলী হলের পেছনে যে সেপটিক ট্যাংকের মধ্যে ফারুকের লাশটি ঢোকানো হয়েছিল সেখানে একটিমাত্র ঢাকনাই খোলা ছিল। আগে থেকে ঠিক করা না থাকলে কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, ওই বিশেষ ম্যানহোলের ঢাকনাই খোলা রয়েছে। অর্থাত্ সবই করা হয়েছে পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে। ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ করে এসেছে মাফলার পরা সাত-আটজনের প্রসঙ্গ। পর্যবেক্ষকরা এর সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তত্পরতা সংক্রান্ত তথ্যও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাদের অনুমান, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যেমন বিদেশি কমান্ডোদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারুক হত্যকাণ্ডেও তেমনি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। পর্যবেক্ষকরা উপরের তথ্যগুলোকে মিলিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন।
‘চিরুনি অভিযান’কেন্দ্রিক পরিস্থিতি যে এরই মধ্যে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে এবং সর্বতোভাবে ভারতের স্বার্থে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নকে বাধাহীন করার জন্য বিরোধী দলের ওপর দমন অভিযান চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য আসলে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হয়ে পড়েছে। সরকারকে ভারত সে সিগন্যালই দিয়েছে। বি. রমনের মতো ভারতের নীতিনির্ধারকরাও কথাটা খোলামেলাভাবে বলেছেন। তারা একই সঙ্গে বাংলাদেশে চুক্তির বিরোধিতাকারীদেরও চিহ্নিত করে দেখিয়ে দিয়েছেন। চুক্তিগুলো যাতে বিরোধিতার মুখে না পড়ে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা যায় সে জন্যই কি ভারতের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারও ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে? পর্যবেক্ষকরা অবশ্য ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, সংবিধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ফ্যাসিবাদী পন্থায় হামলা-নির্যাতন চালানোর পরিণতি কোনো যুগে কোনো দেশে কোনো সরকারের জন্যই সুফল বয়ে আনেনি। ভিন্ন মতালম্বীর সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত করে দেশপ্রেমিক দল ও সংগঠনের বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুর অভিযান চালানো হচ্ছে, তার পরিণতিও এক সময় ধ্বংসাত্মকই হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.