চারদিক-নাম তাঁর ‘কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী’ by কেয়া চৌধুরী

স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা শৌর্য-বীর্যে বীরত্বে দেশপ্রেমের অনন্য স্বাক্ষর বহন করে স্মরণে বরেণ্য হয়ে আছেন, স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী তাঁদেরই একজন। একাত্তরের ২৫ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নিষ্ঠুরতম দিন। সেদিন বর্বর ইয়াহিয়া বাংলার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছিল।


বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার যে দিকনির্দেশনা ছিল, তাতে বাংলার দেশপ্রেমিক সন্তানেরা সঠিকভাবেই দেশাত্মবোধে জাগ্রত হয়ে নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে মোটেও পিছপা হয়নি। এমন হাজারো বীরের গল্প আমাদের অজানা নয়। তেমনি একজন বীর কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে হবিগঞ্জ মহকুমায় যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের সংস্পর্শে থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীর স্কুলছাত্র মানিক ব্রিটিশ হঠাও আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলো। এর এক দিন পর হবিগঞ্জ মহকুমায় খবর এল আর মানিক চৌধুরী সরকারি বৃন্দাবন কলেজের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে হবিগঞ্জ মহকুমায় বিক্ষোভ মিছিলসহ সভা-সমাবেশে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারপর আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়, তাতে তিনি সক্রিয় অংশ নেন।
’৭০-এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বাহুবল-চুনারুঘাট-শ্রীমঙ্গল নির্বাচনী এলাকা থেকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা শুরু হওয়ার পর মানিক চৌধুরী সত্যিকার অর্থেই তাঁর নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে গাছ কেটে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং স্থানীয় ও চা-বাগানের পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়ে একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন, যাঁদের হাতিয়ার ছিল তীর ও ধনুক। এভাবেই তিনি ব্যারিকেড তৈরি করেন, যাতে শত্রুসেনা হবিগঞ্জ মহকুমায় প্রবেশ করতে না পারে। আরও জানা যায়, মাধবপুর থানার তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুসলিম উদ্দিন, সার্কেল অফিসার মমতাজ উদ্দিন মানিক চৌধুরীর কাছে ১২টি রাইফেলসহ ১২ জন কনস্টেবল নিয়ে প্রথমবারের মতো আত্মসমর্পণ করে এবং এভাবেই মানিক বাহিনীর কাছে প্রথম অস্ত্র হাতে আসে। পরবর্তী সময় ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ হবিগঞ্জ ট্রেজারি থেকে ৫৫০টি রাইফেল এবং ২২ হাজার গুলি ছিনিয়ে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন মানিক চৌধুরী। অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুণ্ঠনে যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন, তাতে তিনি মুক্তিফৌজের কাছে নায়ক হয়ে উঠলেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে একটি গ্রাম উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা প্রস্তুতক্রমে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের কাছে পেশ করেন, যা তত্কালীন সব দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ পায় (১২-০১-৭২, বাংলাদেশ অবজারভার )। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি তাঁর এ প্রস্তাবগুলো পুস্তিকাকারে বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থাপন করেন মানিক চৌধুরী। কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী প্রস্তাবিত গ্রাম উন্নয়নের মহাপরিকল্পনায় যা ছিল তা হলো, গ্রামের চিরবঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত সভা, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, জনশাসন এবং উন্নয়নের বিভিন্ন প্রস্তাব। প্রস্তাবিত থানা কাউন্সিলগুলো ছিল স্বায়ত্তশাসিত ও সমবায়ভিত্তিক কাঠামোর আদলে গড়া। পরবর্তী সময় বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ আদর্শে বিশ্বাসী মানিক চৌধুরী বঙ্গবন্ধুরই নির্দেশে ১৯৭৪-৭৫ সালে এ গ্রাম উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটান তাঁর নির্বাচনী এলাকার মাধবপুরে।
যুদ্ধবিজয়ের পর বিধ্বস্ত দেশে চরম অব্যবস্থা বিরাজ করছিল, চুরি-ডাকাতিসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তখন তুঙ্গে। অপরদিকে বন্যায় যখন সাধারণ মানুষের সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব জরাজীর্ণ করে তুলল, তখন মানিক চৌধুরী তাঁর কৃষিবিপ্লবের এক পরিকল্পনার কথা সবাইকে অবহিত করলেন। প্রকল্পের নাম দিলেন ‘ক্ষেতে পানি শ্যামল প্রকল্প’। তিনি ঘোষণা দিলেন কৃষির উন্নয়ন ব্যতীত সমাজের উন্নয়ন হবে না। গ্রাম বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। ‘চল চল গ্রামে চল, গ্রাম-বাংলা গড়ে তোল’ রব তুললেন। প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা হলেন মানিক চৌধুরী। শ্রমশক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে স্বনির্ভর অর্থনীতি এবং নিরাপদ সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রামে মাধবপুরের নারী-পুরুষ ও মানিক চৌধুরী একাত্ম হয়ে এক সবুজ বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর এ প্রকল্প দেখতে মাধবপুরে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন। এ ছাড়া আতাউল গণি ওসমানী, দেওয়ান ফরিদ গাজীসহ সালে নরওয়ের যুবরাজও এ এলাকা পরিদর্শনে আসেন।
আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী বরাবরই তাঁর বিভিন্ন লেখায় ও বক্তব্যে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সুশাসনের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিতেন। তিনি বলেন, যেহেতু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনশাসন-পদ্ধতি গ্রামের মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ, আর গ্রাম বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। ‘কেননা, গ্রামই হচ্ছে দেশের প্রাণ।’
এমনই এক অতিসাধারণ মানুষ ছিলেন মানিক চৌধুরী। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
nhk6903@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.