ইনসাফ বনাম সাফ by এ এম এম শওকত আলী

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটি আনুষ্ঠানিক সভায় বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী পরস্পরকে আক্রমণ করে তীক্ষ্ন বাক্যবিনিময় করেন। প্রসঙ্গটি ছিল মামলাজট। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে নিম্ন-আদালতে অনিষ্পন্ন ২০ লাখ মামলার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।


এ বিষয়েই আইনমন্ত্রীর তীব্র ক্ষোভ ছিল। ক্ষোভবিজড়িত বক্তব্যের মধ্যে ছিল_এক. ঢাকার বাইরে কর্মরত বিচারকরা বৃহস্পতিবার থেকেই ঢাকায় আসার জন্য উদগ্রিব থাকেন, দুই. ঢাকায় অবস্থানের পর রবিবার বিচারকার্য দুপুর ১২টার মধ্যে শুরু করতে ব্যর্থ হন এবং তিন. তিন মাসেও সমন জারি হয় না। এসব সমস্যার প্রতিকারের জন্য আইনমন্ত্রীর সুপারিশ ছিল_ক. সময়মতো কাজ করলে একজন বিচারক এক ডজন মামলা এক দিনে নিষ্পত্তি করতে পারবেন এবং খ. সমন জারির দুই মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
এসব বিষয়ের উত্তরে বিদায়ী প্রধান বিচারপতির প্রতিক্রিয়া ছিল, বিচার বিভাগ হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার মতো স্বাধীনতা পেয়েছে। এ বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় তিনি আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আগে আপনার ঘর সামাল দিন। আপনার দায়িত্ব পালন করুন। বিচারকরা অবশ্যই তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।' এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের যানবাহন সমস্যাসহ বিচারকদের প্রচণ্ড গরমে এসিবিহীন কক্ষে কাজ করার সমস্যা উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে বিচারপতিদের যান ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কারণে রাস্তায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনার মাত্রা কী তা জানা যায়নি। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত সব ধরনের যানবাহনের একই সমস্যা। নির্বাহী বিভাগের মন্ত্রীসহ সব কর্মকর্তাই যানবাহন ব্যবহার করেন। মন্ত্রীদের যানও যে একেবারেই বন্ধ হয় না এ কথা বলা যাবে না। সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা প্রযোজ্য।
বিদায়ী প্রধান বিচারপতির অন্য একটি বক্তব্য সম্পর্কেও কিছু বলা প্রয়োজন। তিনি এসিবিহীন কক্ষে গরমের মধ্যে কাজ করেন। তাঁরা কিভাবে বিচারকদের কষ্টের কথা উপলব্ধি করবেন। এ বাক্যটি সরাসরি আইনমন্ত্রীকেই উদ্দেশ করে বলা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের আগে নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটদেরও অনুরূপ পরিবেশে কাজ করতে হয়। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের সংখ্যার অপ্রতুলতার বিষয় উল্লেখ করে চারজনের জন্য একটি টয়লেটের কথাও বলা হয়েছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার আগেও ম্যাজিস্ট্রেটদের একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখনো টয়লেটের সমস্যা ছিল। তবে এ কথা বলা যায়, সার্বিকভাবে কর্মক্ষেত্রের অবকাঠামোগত সুবিধাদি বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। এটা যেমন বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজন, একইভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োজন। জেলায় নিযুক্ত কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালকদের জন্য অনেক জেলায় কোনো সরকারি দপ্তর নেই। বাসস্থান তো দূরের কথা। অনেকেই এখনো ঘর ভাড়া নিয়ে দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করছেন। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অনেক সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা কাজ করছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁদের অবদান অস্বীকার করা যায় না।
ঢাকার বাইরে কর্মরত বিচারকদের সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিনে ঢাকায় আসার যেমন প্রবণতা রয়েছে, এ প্রবণতা রোধের জন্য প্রশাসনিক নিয়মও রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে অন্তত জেলা পর্যায়ে এ নিয়ম কঠোরভাবে অনুসৃত হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অর্থাৎ বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো সরকারি কর্মকর্তা স্বীয় কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারেন না। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে নিয়ম ভঙ্গের কারণে বিভাগীয় মামলা চালু করা যায়। জেলা প্রশাসকদের ক্ষেত্রে এ কর্মস্থল ত্যাগ করার বিষয়ে প্রচলিত প্রশাসনিক নিয়ম আরো কঠোর। কর্মস্থল ত্যাগ করতে হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পূর্বানুমতি গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ১৯৮৬ সালে ঈদের ছুটিতে ঢাকায় আসার জন্য এক বিভাগীয় কমিশনার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে অনুমতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সোজা উত্তর_ঈদের ছুটি কর্মস্থলেই ভোগ করতে হবে। যেসব বিচারক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকায় আসেন এবং রবিবার কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে দুপুর ১২টায়ও বিচারকাজ শুরু করতে পারেন না, সে ক্ষেত্রে তাঁরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণ না করলে প্রশাসনিক কার্যক্রম কি একেবারেই গ্রহণ করা হয় না_এ কথার কে উত্তর দেবে?
সমন জারি ত্বরিতগতিতে হয় না। বিষয়টি দক্ষ আদালত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। মামলা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অতীতে বিশ্বব্যাংক সহায়তাপুষ্ট একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হয়। এর পরও কোনো সুফল হয়নি। বর্তমানে ইউএনডিপির অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে অন্য একটি প্রকল্প। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আক্রমণাত্মক বাক্যবিনিময় নির্বাহী বা বিচার বিভাগের উচ্চতর কর্মকর্তাদের শোভা পায় না। আলোচ্য ঘটনায় দুই পক্ষেরই প্রতিক্রিয়া ছিল অপ্রত্যাশিত। বিশেষ করে একটি আনুষ্ঠানিক সভাস্থলে। অনিষ্পন্ন মামলার প্রায় সবই ফৌজদারি মামলা। এসব মামলায় সমনের চেয়ে আসামিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যথাসময়ে তামিল করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষীদের জন্য অবশ্য সমন জারির প্রয়োজন। সাক্ষীদের সময়মতো উপস্থিতি ও যথাসময়ে সাক্ষ্য গ্রহণ এবং নিষ্পত্তি করার জন্য জরুরি। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার একটি অন্যতম দুর্বলতা হলো, সমন ও পরোয়ানা যথাসময়ে তামিল করার ব্যর্থতা। অন্য একটি প্রধান দুর্বলতা হলো, সাক্ষীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও একই দিনে সাক্ষ্য গ্রহণ না করে তাদের ফেরত পাঠিয়ে অন্যদিন আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করা। এর ফলে সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে নিরুৎসাহী হয়। প্রধান বিচারপতির একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, 'যে মামলাজটের কথা বললেন, তা কোনো দিনই সমাধান হওয়ার কথা নয়। সময় দেখলে হবে না, ন্যায়বিচার দেখতে হবে। ইনসাফ করতে হবে। সাফ করলেই চলবে না।' উল্লেখ্য, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছিল, ন্যায়বিচার ব্যাহত করে ইনসাফের পরিবর্তে সাফ করার কথা বলা হয়নি। তাঁর বক্তব্যের মর্ম ছিল বিচারকদের কর্মবিমুখতা। যদি মামলাজট নির্মূল করা অসম্ভব হয়, তাহলে কেন অবকাঠামোগত সুবিধাদিসহ ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যার অপ্রতুলতার কথা বলা হলো? এ সুবিধা বৃদ্ধির ফলে মামলাজট নিরসন করা না গেলে কি কর প্রদানকারী নাগরিকদের অর্থের অপচয় হবে না?
এ প্রসঙ্গে যেদিকে প্রথম দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন তা হলো, কর্ম সম্পাদনের মাত্রা নির্ধারণ। কর্মদক্ষতা নিরূপণের জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। অন্যদিকে নির্ধারিত দিনে উপস্থিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য না গ্রহণ করে ফেরত পাঠানো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। এ বিষয়টি নিবিড় পরিবীক্ষণের প্রয়োজন। অতীতে হাইকোর্টের একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো। এ প্রতিবেদনে প্রতিবছর সব ধরনের অধস্তন আদালতে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা, অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা এবং কয়জন সাক্ষী উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ফেরত গেছে তার সংখ্যাসহ কারণও বলা হতো। একই সঙ্গে এসব বিষয়ে হাইকোর্টের মন্তব্যও লিখিতভাবে প্রকাশিত হতো। এর ফলে অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্য বিচারকরা কর্ম সম্পাদনে সচেষ্ট ও সচেতন ছিল। বর্তমানে এ নিবিড় পরিবীক্ষণ-ব্যবস্থা চালু আছে কি না সে বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। চালু না থাকলে, অতীতের ব্যবস্থা আবার চালু করা আবশ্যক। উল্লেখ্য, অতীতে বহু বছর ধরে জেলা ও সেশন জজদের কোনো নির্ধারিত যানবাহন ছিল না। বর্তমানে এ সুবিধা রয়েছে। এমনকি মুখ্য হাকিমের জন্যও এটা রয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যানবাহন-সংক্রান্ত প্রাধিকারের ভিত্তি ছিল সরকারি ভ্রমণের আবশ্যকতা। সে ভিত্তি এখন বিলুপ্ত। কেবল বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে নয়, নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি দৃশ্যমান।
নতুন পদ সৃষ্টির জন্য প্রশাসনিক মানদণ্ড ছিল কাজের চাপ। একসময় সব জেলায়ই অতিরিক্ত জেলা জজ দেওয়া হতো না, এমনকি জেলা জজও না। ফৌজদারি মামলার আধিক্যের ভিত্তিতেই এ ধরনের পদ মঞ্জুর করা হতো। প্রশাসনিক একাংশ অনুযায়ী সব জেলায়ই নতুন পদ সৃষ্টির কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ নিয়ম নির্বাহী বিভাগের জন্যও প্রযোজ্য। বাস্তবচিত্র ভিন্নতর। যুক্তি দেখানো হয়, কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। কত বৃদ্ধি পেয়েছে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয় না। বিচার বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী জনবলসহ অন্যান্য সুবিধা অবশ্যই দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত প্রযোজ্য_এক. চাহিদার যৌক্তিকতা কী এবং তা নির্ধারণ কে করবে; দুই. রাষ্ট্রীয় কোষাগার তা বহন করতে পারবে কি না এবং তিন. এক বছরে সম্ভব না হলে কয় বছরে এটা করা সম্ভব? তবে চাহিদার যৌক্তিকতাই প্রধান বিষয় হবে। এ জন্য ক্ষোভ প্রকাশের কোনো কারণ নেই।
সর্বশেষ সংবাদে জানা যায়, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি পরবর্তী পর্যায়ে প্রকাশ্যে বলেছেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যই ছিল যথার্থ। এ জন্য তিনি বিচারকসহ আইনজীবীদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ধরনের আ@ে@@@াপলব্ধি প্রমাণ করে যে যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তি করার বিষয়টি জটিল। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিচারকের অধিক্ষেত্রের বাইরে। সমন ও পরোয়ানা যথাসময়ে জারি করা সম্ভব হলেও সাক্ষীদের সময়মতো উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি পুলিশের দক্ষতা ও আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে। এ বিষয়ে বিচারকদের খুব একটা দোষারোপ করার সুযোগ নেই। আরো অভিযোগ রয়েছে যে কিছু মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই ঘন ঘন মুলতবির প্রার্থনা করেন। এ ক্ষেত্রে বিচারক নমনীয় না হলেও আইনজীবীদের আন্তরিক হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আইনজীবীরা আন্তরিক হলে এ ত্রুটি অপসারণ করা সম্ভব।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.