একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অধিকতর তদন্তচিত্র by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

আগের দিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে খবরটি প্রথম প্রচারিত হতে শোনা গেল। পরদিন সোমবার ২৩ মে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনায় হারিছ চৌধুরী জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। এ মুহূর্তে হারিছ চৌধুরীর নাম তেমন কোথাও উচ্চারিত হচ্ছিল না।


তাঁকে কোথাও দেখাও যাচ্ছে না। তিনি দেশে নেই, এমনটিই সবাই জানেন। তবে তিনি কোন দেশে আছেন সেই সংবাদও সাধারণভাবে জানা নেই। ২০০৯ সালে নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় সব পলাতক নেতাই দেশে ফিরে এসেছেন, অনেকে এর আগেও ফিরেছেন। কিন্তু হারিছ চৌধুরী ফিরেছেন কি না তেমন কোনো সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখিনি। অর্থাৎ তিনি এখনো নিখোঁজ। বিএনপির সম্মেলন, নতুন নেতৃত্ব গঠন, তাদের আন্দোলন-সংগ্রামও চলছে। অনেক নেতাকেই আমরা দেখছি, মিডিয়ায় অনেকেরই নাম বা ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু একজনকে এখন পর্যন্ত কেউ দেখছে না_তিনি হচ্ছেন হারিছ চৌধুরী।
অথচ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই হারিছ চৌধুরীকে সবাই চিনতেন, জানতেন, দেখতেন এবং তাঁর কথা মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতো। তিনি তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। রাজনৈতিক উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপদেশ দিয়ে থাকেন_এই তো কাজ! তিনি তা-ই হয়তো দিতেন বা করতেন। এমনটি বিশ্বাস করার কারণ হচ্ছে, তখন রাজনৈতিক অনেক বিষয়েই হারিছ চৌধুরী দলীয় প্রধান এবং সরকারপ্রধান খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে মতামত দিতেন, সবাইকে জানানোর কাজ করতেন। ফলে বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদি মোকাবিলা করার চারদলীয় নীতিগত অবস্থান, কৌশল, কর্মপরিকল্পনা_সবই তিনি বলতেন মিডিয়ার সম্মুখে। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে পারতেন, কথা বলায় তাঁর কোনো জড়তা ছিল না। ফলে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী তৎকালীন জোট সরকারের একজন 'স্মার্ট' মুখপাত্রও ছিলেন। তাঁর প্রভাবও লক্ষ করার মতো ছিল। অথচ ২০০১ সালের আগে এমন 'স্মার্ট উপদেষ্টা ও মুখপাত্রের' কথা খুব বেশি মানুষ জানতেন না, তিনিও তেমন আলোচনায় আসতে পারেননি। যতটুকু জানা যাচ্ছে পত্রপত্রিকা পড়ে, হারিছ চৌধুরী ছাত্রজীবনে জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী হলেও জিতে আসতে পারেননি। মির্জা আব্বাসের সহযোগিতায় তিনি বিএনপিতে জায়গা পান বলে কোনো কোনো সূত্র বলছে। ২০০১ সালের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে তিনি তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠতা পান। নির্বাচনের পর হারিছ চৌধুরী চেয়ারপারসন এবং প্রধানমন্ত্রীর এক নম্বর রাজনৈতিক উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করেন। পাঁচ বছর তিনি হাওয়া ভবনের যেমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন, একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন। সেই পাঁচ বছর দেশে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দমন, নিপীড়ন, হত্যা, হামলা-মামলার ব্যাপক ঘটনা ঘটেছে। হয়েছে জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ উত্থানও। তখন বোমা ও গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছিল। আমরা দেখেছি, তখন হারিছ চৌধুরী ওইসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা মিডিয়ার সম্মুখে প্রদান করছিলেন। সব ব্যাখ্যায়ই ছিল তাঁর চাতুর্য, দায়বোধ এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তখন তিনি সব ঘটনারই দায় অস্বীকার করতে পেরেছেন, ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পেরেছেন। এমনকি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যার ঘটনারও ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে পেরেছেন। কিন্তু ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর হারিছ চৌধুরী বোধ হয় দেশত্যাগীদের মধ্যে অন্যতম প্রথম ব্যক্তি, যিনি দেশ থেকে পালিয়ে চলে গেলেন। কোথায় গেলেন জানা নেই। ১/১১-এর পর জানা গেল হারিছ চৌধুরীর বাসাবাড়ি ও অঢেল সম্পদ সম্পর্কে। যে হারিছ চৌধুরীর বাড়ি-গাড়ির নামগন্ধও ঢাকা শহরে আগে ছিল না, তাঁর সুরম্য প্রাসাদ ও সম্পদ রাতারাতি এল কিভাবে? অর্থাৎ তিনি একসময় হঠকারী বাম (জাসদ) রাজনীতি করেছেন। বিএনপিতেও তাঁর অবস্থান বেশি দিনের নয়। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি যতটা প্রভাবশালী ও ধনশালী হলেন, তা দেখে বিস্মিত হতেই হয়। এরই নাম কি রাজনীতি? এঁরাই কি দেশের রাজনীতিবিদের প্রতিনিধিত্ব করছেন বা করবেন? এমন রাজনীতিবিদের নাম যদি কিবরিয়া হত্যা, ২১ আগস্টের হত্যা পরিকল্পনাকারীদের তালিকায় আসে, প্রমাণিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক এক নম্বর উপদেষ্টা যদি এসব হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে গোটা সরকার এবং দলই তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, সে কারণেই কি নিরুদ্দেশ থেকে যাচ্ছেন হারিছ চৌধুরী? এটি আসলে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ, নাকি অন্য কিছু_অনেক প্রশ্ন থেকেই গেল। নতুন করে প্রচারিত সংবাদটি সেই মানুষটির নাম নতুন করে আনার সুযোগ করে দিল। একই সঙ্গে ২০০১-২০০৬ সময়ের রাজনীতিকে নতুন করে স্মরণ করারই যেন ব্যবস্থা করে দিল। সেই সময়ের রাজনীতি শুধু জানা বা স্মরণ করা নয়, শিক্ষা নেওয়ার জন্যই দেশের রাজনীতিকসহ সবার জন্য বেশি বেশি প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাসতত্ত্ববিদ,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.