মিডিয়া ভাবনা-বাণিজ্যমন্ত্রী ১০০ ভাগ অসত্য বলেননি by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান সাংবাদিকদের সম্পর্কে ঢালাও অভিযোগ করে একটি অন্যায় কাজ করেছেন। সাংবাদিক সমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই কলামের মাধ্যমে আমিও এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। আমাদের দেশে সাংবাদিকরা সত্য কথা লেখেন না।


তাঁদের উদ্দেশ্য ব্যবসায়ীদের চেয়েও খারাপ। তাঁরা মিথ্যা ও অর্ধসত্য সংবাদ প্রকাশ করেন। পত্রিকার বিক্রি বাড়িয়ে টাকা উপার্জনের জন্যে তাঁরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব কাজ করছেন।’ মন্ত্রী অবশ্য পরে তাঁর বক্তব্য আংশিক প্রত্যাহার করে বলেছেন, তিনি সব সাংবাদিক সম্পর্কে এ মন্তব্য করেননি।
সাংবাদিকদের সম্পর্কে ঢালাওভাবে এ রকম সমালোচনা করা যায় না। কারণ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিক নিজের পেশার প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল। সত্য উদ্ঘাটনে তাঁদের তৎপরতা খুবই প্রশংসনীয়। দূষিত রাজনীতি ও নানা ক্ষেত্রে সরকারের অপশাসনের মধ্যেও এ দেশ যে এখনো কিছুটা বাসযোগ্য, তার পেছনে স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেকখানি। স্বাধীন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা যদি তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হতেন বা সব সাংবাদিক যদি ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ বা গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে নতি স্বীকার করে নতজানু সাংবাদিকতায় নিবেদিত হতেন, তাহলে দেশের অবস্থা কী হতে পারত তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। স্বাধীন গণমাধ্যম বিভিন্ন মন্ত্রী, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, সরকারের নানা ব্যর্থতা, অপশাসন, সরকারি দলের নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরছে বলেই আজ দেশে গণতন্ত্র, আংশিক সুশাসন, আংশিক জবাবদিহি, আংশিক দুর্নীতি রোধ সম্ভব হয়েছে। তাই স্বাধীন, সৎ ও পেশাদার সাংবাদিকদের প্রতি দেশের মানুষ কৃতজ্ঞ।
বাণিজ্যমন্ত্রীর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ তোলা ঠিক হয়নি। পাকিস্তানি আমল, স্বাধীনতার পটভূমি রচনা, মুক্তিযুদ্ধ—ইতিহাসের এসব অধ্যায়েও এ দেশের স্বাধীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা যে ঐতিহাসিক ও গণমুখী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অনেক পাঠক জানেন। আশা করি, বাণিজ্যমন্ত্রীও তা জানেন।
তবে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা ১০০ ভাগ অসত্য, এটা আমি মনে করি না। এর মধ্যে কিছু সত্যতা আছে। বাণিজ্যমন্ত্রী যদি শব্দ ব্যবহারে একটু সতর্ক হয়ে ‘কিছু সাংবাদিক’ বলতেন (পরে যা তিনি সংশোধন করে নিয়েছেন), তাহলে তাঁকে আজ এই সমালোচনা ও নিন্দার শিকার হতে হতো না। সব সাংবাদিককে এই সমালোচনার ব্র্যাকেটে বন্দী করাতেই যত বিপত্তি হয়েছে।
একটা কথা এই কলামে আমি আরও কয়েকবার লিখেছি। অন্যরাও নানা লেখা ও বক্তব্যে তা উল্লেখ করেছেন। তা হলো, এ দেশের, বিশেষ করে ঢাকার কয়েকটি সংবাদপত্র ও কিছু সাংবাদিক, কলামিস্ট সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা মেনে চলেন না। তাঁরা ‘ফ্রি স্টাইল’ সাংবাদিকতা করেন। তাঁরা ভিন্ন অর্থে ‘স্বাধীন সাংবাদিক’। কিছু পত্রিকার মালিক, সাংবাদিক ও কলামিস্টের ত্রয়ী জোট দেশে এই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র জন্ম দিয়েছে। এসব পত্রিকা সাংবাদিকতা ও ব্যবসা করার জন্য প্রকাশিত হয়নি। নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে এসব পত্রিকা ‘গোষ্ঠীবিশেষের’ স্বার্থ রক্ষা করছে। হয়তো ব্যবসাটা অন্যভাবে হচ্ছে, পত্রিকা বিক্রি করে নয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘আমাদের দেশে সাংবাদিকরা (পড়তে হবে ‘কিছু সাংবাদিক’) সত্য কথা লেখেন না।’ এ কথা কি ১০০ ভাগ অসত্য? যেসব প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর নিন্দা করেছেন, তাঁরা কি নিশ্চিত হয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বলতে পারবেন, আমাদের দেশের সব সাংবাদিক (ও কলামিস্ট) সব সময় সত্য কথা লেখেন? সঠিক তথ্য লেখেন? বিবৃতিদাতারা এ কথা বলতে পারবেন?
প্রবীণ সাংবাদিক, সম্পাদক ও ইউনিয়নের নেতারা সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে চলার জন্য খুব সোচ্চার নন। তাঁরা সংবাদপত্রের পাঠকও। তাঁরা জানেন, কারা বা কোন পত্রিকা হলুদ সাংবাদিকতা করছে। তবু তাঁরা তাঁদের কোনো লেখায় এর সমালোচনা করেন না। প্রবীণ সাংবাদিকেরা সবার কাছে প্রিয় থাকতে চান। আর ইউনিয়ন নেতারা দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে সাংবাদিকতার নীতিমালা বা পেশার মর্যাদার ব্যাপারে ভাবার সময় তাঁদের হয় না। তাঁরা তাঁদের ভোটব্যাংক সংরক্ষণে বেশি তৎপর।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা পড়ান বা এ বিষয়ে গবেষণা করেন, এ রকম প্রবীণ ব্যক্তিও কম নেই। তাঁদের লেখায় বা বক্তব্যে এই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ বা ‘অপসাংবাদিকতা’ সম্পর্কে তেমন সমালোচনা দেখি না।
আমাদের সংবাদপত্র অনেক বড় একটি প্রতিষ্ঠান। কয়েক হাজার সাংবাদিক এই পেশার সঙ্গে জড়িত। সারা দেশ থেকে প্রায় ৩৫০টি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ‘সাংবাদিকতা’ নিছক একটি পেশা নয়। ‘সংবাদপত্র’ শুধু একটি ব্যবসাও নয়। সংবাদপত্রকে দেশের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ (নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, বিচারব্যবস্থা ও সংবাদপত্র) বলা হয়। কাজেই এর গুরুত্ব বিরাট। এ রকম একটি মহান পেশাকে মাত্র কয়েকটি পত্রিকার মালিক ও তাঁদের বশংবদ সাংবাদিক কলুষিত করে ফেলছে—এটা খুবই দুঃখজনক। সমগ্র সংবাদপত্র জগতে তারা এক শতাংশও নয়। অথচ এই ক্ষুদ্র অংশের জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী সমগ্র সাংবাদিক-সমাজ সম্পর্কে এত বড় অভিযোগ করার সাহস করেছেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও একটি সত্য কথা বলেছেন। ‘পত্রিকার (পড়তে হবে ‘কিছু পত্রিকার’) বিক্রি বাড়িয়ে টাকা উপার্জনের জন্যে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব কাজ করছে।’ এ কথা কি ১০০ ভাগ অসত্য? আমরা প্রতিদিন রাজপথে, বাসে এসব পত্রিকা বিক্রি হতে দেখছি না?
আজকাল গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ, দাগি আসামি ও ভূমিদস্যু দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করছে। যেকোনো সময় আদালত তাদের জেলে ভরতে পারেন। কারাদণ্ডের ভয়ে তারা তাদের সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারের ইচ্ছা পূরণ করে চলেছে। বেচারা! সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মতো মহান পেশা যে এ রকম একটি কদর্য কাজেও ব্যবহূত হতে পারে, তা এক দশক আগে কেউ কল্পনাও করেনি। সরকারের ইচ্ছামতো ‘খবর’ বা ‘কলাম’ প্রকাশ না করলেই তাদের দুর্নীতির ফাইল নড়েচড়ে উঠবে। কী গ্যাঁড়াকল রে বাবা! সংবাদপত্র-মালিকের এমন দুর্দশা পৃথিবীর আর কোথাও কেউ দেখেছেন কি না জানি না। বাংলাদেশে আমরা দেখছি।
সংবাদপত্রে ব্যক্তিগত কুৎসা ও ভিত্তিহীন অপপ্রচার যে কোন পর্যায়ে নেমে গেছে, তা ঢাকার কয়েকটি দৈনিক না পড়লে জানা যেত না। এসব পত্রিকার ভাগ্য ভালো যে, যাদের বিরুদ্ধে তারা লিখছে তারা কখনো এত নিম্ন পর্যায়ে ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করবেন না। সেই কুরুচি তাদের হবে না বলেই মনে হয়। যদিও তাদের হাতেও বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা রয়েছে।
সংবাদপত্র হলো তথ্যভিত্তিক সাংবাদিকতার স্থান। ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করার জায়গা নয়। এ ধরনের কুৎসা রটনা করে বস্তিবাসীরা। কোনো দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক বা সাংবাদিক নিজেদের যদি বস্তিবাসীর পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চায়, তাহলে তাদের রক্ষা করবে কে?
সংবাদপত্রে যাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করা হয়েছে তারা যে এসব লেখার কোনো প্রতিবাদ করেনি, তা প্রশংসাযোগ্য কাজ হয়েছে। সব অসত্য লেখার প্রতিবাদ করার প্রয়োজন হয় না। প্রতিবাদ করলে বরং ‘বস্তি সাংবাদিকতা’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য তারা নয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব ফারুক খান সংবাদপত্রে ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করার এই প্রবণতার কথা বলেননি। এই অভিযোগও যদি তিনি করতেন, তাহলে কি অস্বীকার করা যেত? ‘কুৎসা সাংবাদিকতা’র সঙ্গে কি পাঠক পরিচিত নয়?
ফারুক খানের সমালোচনার সূত্র ধরে একটি পত্রিকার সম্পাদক ‘মন্তব্য প্রতিবেদনে’ বলেছেন, ‘আমরা দাবি করি না যে, সব সাংবাদিকই ধোয়া তুলসীপাতা।’ (৭ এপ্রিল)
তিনি যথার্থই বলেছেন। আমার আজকের লেখাটি তাঁর এই মন্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। তবে ‘মন্তব্য প্রতিবেদনে’ তাঁর একটি বক্তব্যের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত হতে পারছি না। তিনি লিখেছেন, ‘যদি কারো বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, প্রমাণসমেত প্রেস কাউন্সিলেও যেতে পারেন সরকারের যে কেউই।’ (ঐ)
মন্তব্য লেখক কি বলবেন, প্রেস কাউন্সিলে গিয়ে কী হবে? প্রেস কাউন্সিলের কী ক্ষমতা আছে? প্রেস কাউন্সিল কি দোষী সাংবাদিককে শাস্তি দিতে পারে? দোষী সম্পাদককে শাস্তি দিতে পারে? আমার জানামতে, কিছুই পারে না। পারে শুধু ভর্ৎসনা করতে। এটা কি কোনো শাস্তি হলো?
কোনো সংবাদপত্র ও সাংবাদিক একজন মানী ব্যক্তির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে পত্রিকায় লিখেছেন। প্রেস কাউন্সিলে এ নিয়ে অভিযোগ করলে এবং সাংবাদিক দোষী প্রমাণিত হলে প্রেস কাউন্সিল তাঁকে শুধু ভর্ৎসনা করে ছেড়ে দেবে—এটা কি সুবিচার? আদৌ কোনো বিচার?
স্বয়ং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত একটি খবরের সূত্র ধরে সংবাদপত্রে মিথ্যা খবর প্রকাশের সমালোচনা করেছিলেন জাতীয় সংসদে। তিনি বলেছিলেন, ‘এর প্রতিকার করতে হবে।’ কিন্তু তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানেও সাড়া দেননি। তিনি ‘প্রেস কাউন্সিল’কে শক্তিশালী করে অপসাংবাদিকতা প্রতিরোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানও এ দেশে উপেক্ষিত হয়।
যা হোক, আমি আবার বলব, বাণিজ্যমন্ত্রী ১০০ ভাগ অসত্য কথা বলেননি। আমাদের সাংবাদিকতার একটি ক্ষুদ্র অংশ সব সময় সত্য কথা লেখে না। তারা মিথ্যা ও অর্ধসত্য সংবাদ প্রকাশ করে। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে লাভ নেই। সাংবাদিকেরা অন্যের সমালোচনা যথেষ্ট করেছেন, এবার একটু আত্মসমালোচনায় মন দিলে ভালো হয়। এতে ‘সাংবাদিকতা’ পেশার উপকার হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.