সমুদ্রজয়-হামবুর্গ এবং নতুন দিগন্ত by মামুন রশীদ

সাফল্য নতুন সাফল্যের জন্ম দেয়। অন্ততপক্ষে আশাবাদ সৃষ্টি করে। আমরা এখন আশা করতেই পারি যে দি হেগে জাতিসংঘের স্থায়ী কোর্ট অব আরবিট্রেশনে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যে মামলা তাতে জয়ী হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং বিশেষভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একই উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে।


এ রায় হওয়ার কথা ২০১৪ সালে। সন্দেহ নেই, ভারতীয় পক্ষও তৎপর থাকবে। কূটকৌশলও থাকা স্বাভাবিক


আমার ঘনিষ্ঠ ক'জন বন্ধুর অনুযোগ কিংবা বলতে পারি অভিযোগ ছিল_ মহাজোট মন্ত্রিসভার কয়েকজন অদক্ষ মন্ত্রীর প্রতি আমি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। এ তালিকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও রয়েছেন। তারা মনে করেন, আমাদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে চিকিৎসক ও আইন বিষয়ে পড়াশোনা করা এ নারীর অবদান প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। এবং তাদের কেউ কেউ, যাদের মধ্যে অর্থনীতিবিদও রয়েছেন_ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘন ঘন বিদেশ সফর আমাদের 'বাজেট ঘাটতিকে' ধারণার বাইরে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মনে করেন। হ্যাঁ, ডা. দীপু মনিকে আমি পছন্দ করি। তিনি তুলনামূলক কম বয়সী। কথা বলেন গুছিয়ে ও স্পষ্ট করে। ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ, একইভাবে বাংলাতেও। তার সামনে এগোনোর সুযোগ রয়েছে বা তিনি অনেক দূর যেতে পারেন, যাকে আমরা বলি লংওয়ে টু গো। এজন্য শর্ত হচ্ছে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া। এভাবে আমাদের দেশ এবং তার দলের জন্য তিনি অবদান রাখতে পারেন। তাছাড়া তিনি বিনয়ী, মুরবি্বদের আগ বাড়িয়ে সালাম দেন এবং আমিও এ সৌজন্য পেয়েছি। তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে এবং সহজাতভাবে কুশল জানতে ইচ্ছুক দেখেছি তাকে। তবে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কিছু সমস্যা সামাল দিতে তিনি অপটুত্ব প্রকাশ করেছেন এবং এজন্য সমালোচনাও ছিল যথার্থ। এ ক্ষেত্রে আমরা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি।
তবে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলায় বাংলাদেশ জয়ী হওয়ার পর দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন। হামবুর্গ থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনি বীরের সম্মানে অবতরণ করেছেন। এভাবে ফুলেল সংবর্ধনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর সম্ভবত প্রথম। আমরা অনেকেই তাকে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়েছি। বিশেষভাবে আমরা স্মরণ করেছি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খুরশেদ আলমকে। জার্মানির বাংলাদেশ মিশনের কর্মীরাও সমুদ্র আইন বিষয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের জয়ে অবদান রেখেছেন। হামবুর্গ ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেছেন ১৪ মার্চ। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে এবং বলা যায়, চাওয়ার চেয়েও যেন প্রাপ্তি বেশি। সমুদ্রে এখন আমাদের স্বীকৃত এলাকার আয়তন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কাছাকাছি। এখন এ এলাকায় অবাধে সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের পথ খুলে গেল। এই যে সম্মিলিত চেষ্টায় অর্জন, তার সূচনা ঘটেছিল ১৯৭৪ সালে। সে সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সাফল্য নতুন সাফল্যের জন্ম দেয়। অন্ততপক্ষে আশাবাদ সৃষ্টি করে। আমরা এখন আশা করতেই পারি যে দি হেগে জাতিসংঘের স্থায়ী কোর্ট অব আরবিট্রেশনে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যে মামলা তাতে জয়ী হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং বিশেষভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একই উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এ রায় হওয়ার কথা ২০১৪ সালে। সন্দেহ নেই, ভারতীয় পক্ষও তৎপর থাকবে। কূটকৌশলও থাকা স্বাভাবিক। মিয়ানমারের সঙ্গে মামলার রায় পর্যালোচনা থেকে তাদের নিশ্চিত ধারণা হওয়ার কথা সম্ভাব্য ফল কী হতে পারে। এ কারণে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা বলা হচ্ছে। ২০০৫ সালে ভারতের তৎকালীন বিদ্যুৎ সচিব 'সাউথ এশিয়ান এনার্জি নেটওয়ার্কের' এক আলোচনার ফাঁকে আমাকে বলেছিলেন, এনার্জি খাতে দুই দেশের বিদ্যমান ইস্যুগুলো দ্বিপক্ষীয়ভাবেই নিষ্পত্তি হতে হবে, কোনোভাবেই নেপাল বা ভুটানকে টেনে আনা যাবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সমুদ্র ইস্যুতে এ পথে আমরা চলব না। আমরা যদি এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে অনুকূল রায় পেয়ে যাই, তাহলে অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলোতেও একই ধরনের পদক্ষেপের কথা ভাবা যেতে পারে। পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে আমরা ক্রমাগত বঞ্চিত থাকছি এবং অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহারে ভারত একের পর এক একতরফা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ভারতের অনেক রাজনীতিক এবং হাল আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো 'প্রো-পিপল' নেতাও বাংলাদেশকে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করায় উঠেপড়ে লেগেছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রদত্ত একটি নির্দেশনাও আমরা স্মরণ করতে পারি। আদালত বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের পরিণতি কী হবে, সেটা আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি প্রত্যাহার।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গত চার দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, দ্বিপক্ষীয় কাঠামোয় সব সমস্যা সমাধানের ভারতীয় ফর্মুলা বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে আমি মনে করি বাংলাদেশকে অবিলম্বে ১৯৯৭ সালের নন-নেভিগেশনাল ইউস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্স সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৭-এ স্বাক্ষর করতে হবে। একই ধরনের অনুরোধ জানাতে হবে ভারতকে, যাতে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক আদালতে এ বিরোধের নিষ্পত্তি হতে পারে। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র নিয়ে বিরোধের অবসান ঘটেছে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণে দুশ্চিন্তা কেটে যাওয়ায় বাংলাদেশ পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবতে পারে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হতে হবে। সৌভাগ্যের বিষয়, ইতিমধ্যে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে, সেটাও এ প্রক্রিয়ার সহায়ক হবে বলে আমার ধারণা। ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদারের জন্য গ্রহণ করা চাই বিশেষ উদ্যোগ। খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার ইস্যুতে সেখানকার বিজনেস হাউসগুলোতে আমাদের স্বাভাবিক মিত্রও খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের দেশ এবং জনগণের জন্য সেরাটা বের করে আনার জন্য কেবল একজন দীপু মনি বা একজন খুরশেদ আলমের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। আমাদের বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দক্ষতা বাড়িয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কূটনীতিকদের জন্যও এটা প্রয়োজন। অনেকের মতো আমিও বলব, মন্ত্রী ও রাজনীতিকদেরও এর আওতায় আনা চাই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের মতো গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়িয়ে চলার প্রতিও মনোযোগী হতে হবে।

মামুন রশীদ : ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.