বাজেট-রপ্তানিকারকরা ১৪৭টি সুবিধা চেয়েছেন

আগামী বাজেটে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাতগুলোর জন্য ১৪৭ ধরনের সুবিধা দাবি করেছে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠানো সংগঠনটির দাবিনামার সারমর্ম হলো- রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে আমদানি শুল্ক নেওয়া যাবে না, ভ্যাটও না।


রপ্তানিকারকরা ১০০ টাকা রপ্তানি করে ২৫ পয়সার বেশি করও দিতে চান না। নিজেদের ব্যবহারের জন্য ইটিপি আমদানি করবেন, কিন্তু সে জন্য যে ব্যাংক ঋণ নেবেন সেখানে ৩ শতাংশের বেশি সুদ দেবেন না তাঁরা। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে পাওয়া নগদ সহায়তা দ্বিগুণ-তিন গুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। যেসব কারখানা গ্যাস সংযোগ পায়নি, তাদের ব্যাংক ঋণের সুদেও ভর্তুকি দিতে হবে সরকারের পকেট থেকে। বিলাসী ও মূল্যবান হীরা আমদানির ক্ষেত্রেও সব ধরনের শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক বাদ দেওয়ার দাবি তাঁদের। এমনকি, গার্মেন্ট মালিকরা তৈরি পোশাকের ওপর যে লেবেল (স্টিকার) লাগান, তা মজুদ করে রাখার জন্য সরকারি টাকায় বন্ডেড ওয়্যারহাউস নির্মাণের দাবিও রপ্তানিকারকদের। এসব দাবির পেছনে তাঁরা 'আন্তর্জাতিক ঘোলাটে পরিস্থিতি আর দেশের অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে' কারণ হিসেবে জাহির করছেন।
রপ্তানিকারকদের নানা দাবিতে অতিষ্ঠ রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, রপ্তানিকারকরা শুধু রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের গল্প শোনান। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ যে তাঁরাই আমদানির পেছনে খরচ করেন, তা কখনো বলেন না। সব ধরনের আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাওয়া, সব ক্ষেত্রেই করমুক্ত ও ভ্যাটমুক্ত সুবিধা আদায় করে নেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। নিজেরা ব্যবসা করেন, মুনাফার টাকাও ভোগ করেন তাঁরা, উল্টো সরকারের কাছ থেকে নেন শতকরা পাঁচ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত নগদ সহায়তা। তাঁদের দাবি দেখে মনে হয়, সরকারকে ঋণ করে রপ্তানিকারকদের পেছনে টাকা খরচ করতে হবে।
শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা, ভ্যাট ও আয়করমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পর রপ্তানিকারকদের জন্য এত সুবিধা সরকার কোথা থেকে দেবে- এমন প্রশ্ন করা হলে ইএবি সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, 'আমরা ১০০ টাকা রপ্তানি করলে সেখান থেকে সরকারকে ২৫ পয়সা উৎসে কর দেব। সেই থেকেই আমাদের নগদ সহায়তা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।' রপ্তানিকারকরাই যে আমদানির পেছনে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করেন সে কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, 'এ বছর আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি ঘোলাটে। দেশেও অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে আমাদের দাবির পরিমাণ বেশি।'
এনবিআরে পাঠানো সংগঠনটির দাবিনামার শুরু বস্ত্র ও পোশাক খাত দিয়ে। শুধু এই খাতের জন্য ২১টি দাবি তাদের। এতে রয়েছে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা ও তা করমুক্ত রাখা। যেসব যন্ত্র আমদানির কথা এসআরও-তে নেই, তা ব্যবসায়ী সমিতির সুপারিশে খালাস করার দাবিও তাদের। সংগঠনটি বলেছে, ফ্যাক্টরি ও অফিস ভাড়ায় কোনো ভ্যাট নয়, উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, ২০০৯ সালের ৩ আগস্টের আগে এ খাতের ব্যবসায়ীরা যে ঋণ নিয়েছেন, তার সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ খাতের জন্য যেসব পণ্য, রাসায়নিক ও অন্যান্য উপকরণ দরকার হয়, তার সবই শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির সুযোগ দেওয়া। আর নতুন যন্ত্রাংশ ও পুরাতন মূলধনী যন্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে প্রাকজাহাজীকরণ তদন্ত (পিএসআই) এর আওতামুক্ত রাখাসহ শুধু পোশাক শিল্পের জন্য সরকারি টাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য আবাসন নির্মাণের কথা বলে রপ্তানিকারকরা ১ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা আগেই পেয়েছেন, এবার তাঁদের চাওয়া ভবন নির্মাণসহ সিএসআর কাজে যে অর্থ ব্যয় হবে; সেখানে মোটেই কোনো কর চাওয়া যাবে না।
এ খাতের আরেকটি উপখাত হলো টেরিটাওয়েল ও লিনেন। এ খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা, বিনাশুল্কে আমদানি সুবিধা ও প্রণোদনা স্কিম হতে এ খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আলাদা করে বরাদ্দ রাখার দাবি করেছে ইএবি। রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট ওয়াশিং খাতের জন্য ইএবির দাবি- গ্যাস সংযোগ না দেওয়ায় ব্যাংক ঋণের বিপরীতে আর্থিক সহায়তা দেওয়া, এ সেক্টরকেও প্রণোদনার আওতায় নেওয়া, ৩ শতাংশ সুদে ইটিপি কিনতে ঋণ দেওয়া। একই ধরনের সুবিধা চাওয়া হয়েছে গার্মেন্ট প্রিন্টিং খাত, গার্মেন্ট লেবেল উপখাতের জন্যও। গ্রে অ্যান্ড ফিনিশড ফেব্রিক রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ করা ও ৫ শতাংশ সুদে ১০ বছর মেয়াদি ঋণ দিতে হবে বয়লার ও জেনারেটর আমদানির জন্য।
অন্যান্য রপ্তানি খাতের মধ্যে হিমায়িত খাদ্যের জন্য নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা, জাহাজ রপ্তানির বিপরীতে এ হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ, কারওয়ান বাজারের জনতা টাওয়ার থেকে সরকারি অফিসগুলো সরিয়ে পুরোটাই সফটওয়্যার ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া এবং কাঁচা পাট রপ্তানিকারকদের ১৯৮৫-৮৬ সালে নেওয়া ব্যাংক ঋণের সুদ সম্পূর্ণভাবে মাফ করে আসল অর্থ ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া। ক্রাস্ট চামড়া রপ্তানির বিপরীতে ৫ শতাংশ, ফিনিশড চামড়ায় সাড়ে ৭ শতাংশ ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা চেয়েছে ইএবি। এ ছাড়া ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে যে অর্থ মালিকদের খরচ হবে- সে টাকাও চেয়েছে সরকারের কাছ থেকে।
এনবিআরের কাছে পাঠানো দাবিনামায় রেশম পণ্য রপ্তানির বিপরীতে ২০ শতাংশ, সি-আর কয়েলে ২০ শতাংশ, হোগলা থেকে প্রস্তুত করা রপ্তানি পণ্যে ২০ শতাংশ, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানিতে ৩০ শতাংশ এবং ফল ও সবজি রপ্তানির বিপরীতে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দাবি করেছে সংগঠনটি। এ ছাড়া পান রপ্তানি করতে যে বিমান ভাড়া খরচ হয় তার অর্ধেক সরকারের কাছে দাবি করেছে ইএবি।

No comments

Powered by Blogger.