সংবিধান-বাহাত্তরের কাঠামোতে কতটুকু ফিরল? by আবু সাঈদ খান

জনমনে প্রত্যাশা ছিল, সাংসদদের গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্র বিকশিত করতে ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে। কিন্তু যে সংশোধনী আনা হয়েছে এর সঙ্গে আগের বিধানের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সরকার গঠন বা সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থার ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ভোটদানের বাধা দূর করলে সেটি হতো অধিকতর


গণতান্ত্রিক। পঞ্চদশ সংশোধনী গণতান্ত্রিক অধিকার প্রসারিত করেছে এমন দাবির সুযোগ নেই। এটি মৌলবাদী ও জঙ্গিদের রাজনীতি করার
সুযোগ দিয়েছে, আর কেড়ে নিয়েছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার


বাহাত্তরের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের ফসল। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিকশিত চেতনা ও মূল্যবোধ এতে বিধৃত হয়েছিল। রাষ্ট্র পেয়েছিল দেশ পরিচালনার যুগোপযোগী দিকনির্দেশনা। কিন্তু চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টমসহ বিভিন্ন সংশোধনীর ছুরিতে এটি ক্ষতবিক্ষত, বিকৃত ও লক্ষ্যচ্যুত হয়; সংবিধানের গায়ে পরানো হয় ধর্মীয় ও অগণতান্ত্রিক আলখাল্লা।
দীর্ঘদিন ধরে একাত্তরের বিজয়ী জাতির দাবি ছিল বাহাত্তরের সংবিধানের মূল কাঠামোতে সংবিধানকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী বাম দলগুলো এ দাবির সঙ্গে কেবল সহমত ছিল না, এ ব্যাপারে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারও ছিল। এমনই একটি প্রেক্ষাপটে মহাজোট সরকারের হাতে অতিসম্প্রতি সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী পাস হলো। এখন প্রশ্ন, এ সংশোধনীর পর বাহাত্তরের সংবিধানের প্রত্যাবর্তন কি ঘটেছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কতটুকু সমুন্নত হয়েছে?
পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে চার রাষ্ট্রীয় নীতিমালা সংবিধানে পুনঃস্থাপিত হয়েছে, যা বাহাত্তরের সংবিধানের অবিকল। সেটি হচ্ছে '৮। (১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_ এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ থেকে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' এটি নিঃসন্দেহে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনায় প্রত্যাবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ_ এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। তবে একই সঙ্গে সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' ও 'রাষ্ট্রধর্ম' বিধান অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। রাজনীতির শিশুও বুঝতে পারে যে, রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার পরস্পরবিরোধী অবস্থান। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যায় (যা এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে পুনঃসংযোজিত) ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান করবে না। কিন্তু ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করায় কি বিশেষ মর্যাদা দান করা হচ্ছে না? এখানে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা '২। ক রাষ্ট্রধর্ম' বিধানের সঙ্গে নতুন জুড়ে দেওয়া লাইনটির কথা বলছেন। বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।' কথাটির অর্থ হচ্ছে যে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার থাকবে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আসীন, অন্য কোনো ধর্ম নয়। এটি সবারই বোধগম্য যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করতে এটি করা হয়েছে। এই গোঁজামিল কোনো শুভফল বয়ে আনবে না। সংবিধানের এই ধর্মীয় প্রলেপের কারণে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র, কখনও ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ সংশোধনীর পর ধর্মীয় তকমা বদলাবে না। বরং এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা ও ধেঁাঁয়াশা সৃষ্টি হবে। এটি কারও কাছে হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, কারও কাছে ধর্মরাষ্ট্র, যা রাষ্ট্রের নীতিগত পরিচয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো না এ সংশোধনীর মাধ্যমে। ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশে বাঙালির পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, সাঁওতাল, গারো, খাসিয়া, মণিপুরিসহ বিভিন্ন জাতি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। তারাও দেশমাতৃকার সন্তান। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে বাঙালির পাশাপাশি স্বল্পসংখ্যার জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লড়েছে। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধান রচনার সময় তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি উপেক্ষিত হয়। সেটিই ছিল বাহাত্তরের সংবিধানের বড় ত্রুটি। বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাদের অনেকেই সেটি স্বীকার করেন। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেনও একাধিকবার বলেছেন, তখন আমরা ভুল করেছি। এবার সেই ভুল সংশোধিত হবে_ এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংখ্যালঘু জাতি ও আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়টি উলি্লখিত আছে। কিন্তু এ সমস্যার মর্যাদাপূর্ণ সমাধান হয়নি। বরং ৬ অনুচ্ছেদে নতুন সংশোধনী এনে 'নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন'-এর স্থলে প্রতিস্থাপিত হয়েছে 'বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন'। এই বিধানটির মধ্য দিয়ে অন্যান্য জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। আবারও বাঙালি বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কি-না, সেই প্রশ্ন এসে যায়।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ কেবল বাঙালির রাষ্ট্র নয়, অন্যান্য জাতিরও রাষ্ট্র। একইভাবে বাংলাদেশ কেবল মুসলমানের রাষ্ট্র নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরও রাষ্ট্র। সংবিধানকে বাঙালিকরণ ও ইসলামীকরণ দুই-ই সংখ্যালঘুদের অধিকারের লঙ্ঘন, আধিপত্যবাদী মানসিকতাপ্রসূত। এর ফলে বাংলাদেশে বাঙালি-মুসলমানের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে; যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
আমরা কি একাত্তরে ধর্মভিত্তিক দেশ পাকিস্তানের কবরের ওপর আরেকটি ধর্মভিত্তিক দেশ গড়ার জন্য যুদ্ধ করেছি? না, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি_ ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণহীন বাংলাদেশ ছিল আমাদের লক্ষ্য। এ সত্য কি বিস্মৃত হওয়া সম্ভব? এ সত্যের প্রতিফলন থাকতে হবে সংবিধানে এবং সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে। এখানে ধর্ম হবে যার যার, রাষ্ট্র সবার। এই সত্য অনুধাবনেই রাষ্ট্রের সংহতি, উন্নয়নের শক্তি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া। বাস্তবতা মেনে নিয়েই এবার সাধ এবং সাধ্যের সম্মিলন ঘটানো যায়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চার নীতির পাশাপাশি বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্মকে ৭ খ। অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংশোধন অযোগ্য বলে বিধান করার পর এ সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটানো কখনও কি সম্ভব?
পঞ্চম সংশোধনীর ওপর আদালতের রায়ে সংবিধানের ৬নং অনুচ্ছেদের পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে নাগরিক পরিচয় বাংলাদেশি স্বীকৃত হওয়ায় পুরনো বিতর্কের সমাধান মিলেছিল; যেখানে প্রয়োজন ছিল ৯ অনুচ্ছেদে বাঙালির পাশাপাশি অন্যান্য জাতিসত্তা ও আদিবাসীদের কথা উল্লেখ করা। সেটি না করে সব জাতি ও আদিবাসীদের বাঙালি বানানোর ভ্রান্ত তত্ত্ব আবার আওয়ামী লীগ উপস্থাপন করল; এর ফলে সংহতির ভিতে নতুন করে ফাটল দেখা দেবে কি-না তা কি তারা ভেবে দেখেছেন?
আদালতের রায়ে পুনরুজ্জীবিত ৩৮নং অনুচ্ছেদের সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। আমরা পাকিস্তানের ২৪ বছরে ধর্মের নামে শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নের শিকার হয়েছি। একাত্তরে ধর্ম রক্ষার নামে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামসহ ধর্মের ধ্বজাধারীরা নির্মম গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট করেছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বাহাত্তরের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুযায়ী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুযায়ী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি গঠন, সদস্যপদ লাভ বা এমন তৎপরতায় অংশ নেওয়া যাবে না। এটি সংশোধন করে মৌলবাদী ও জঙ্গি দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ায় জাতিকে এর খেসারত আবার নতুন করে দিতে হবে বলে মনে হয়।
সমাজতন্ত্র পূর্ণ অবয়বে ফিরে এলেও রাষ্ট্রীয় নীতি ও কর্মকাণ্ডে তার প্রতিফলন কতটুকু হবে? জানি না সমাজতন্ত্রকে কেতাববন্দি করে মুক্তবাজারের যে চর্র্চা চলছে সেটিকে অব্যাহত রাখা হবে কি-না। আর তা হলে সেটি হবে আত্মপ্রতারণারই শামিল।
মহাজোট সরকারের বড় দাবি, এ সংশোধনীর ফলে অবৈধ ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ হয়েছে। অবৈধভাবে সংবিধান বাতিল ও স্থগিতকরণের ব্যাপারে সংবিধানে নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন গুরুত্বপূর্ণ। নতুন সংযোজিত বিধানে বলা হয়েছে, '৭ক। সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ।_(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়_ (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে বা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে, কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিক আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে_
তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। (২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত (ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে_ তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।' এটি একটি যৌক্তিক সংযোজন। কিন্তু আইন করে অবৈধ ক্ষমতা দখলের খেলা ঠেকানো যায় কি-না সে প্রশ্ন তোলা যায়।
জনমনে প্রত্যাশা ছিল, সাংসদদের গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্র বিকশিত করতে ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে। কিন্তু যে সংশোধনী আনা হয়েছে এর সঙ্গে আগের বিধানের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সরকার গঠন বা সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থার ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ভোটদানের বাধা দূর করলে সেটি হতো অধিকতর গণতান্ত্রিক।
পঞ্চদশ সংশোধনী গণতান্ত্রিক অধিকার প্রসারিত করেছে এমন দাবির সুযোগ নেই। এটি মৌলবাদী ও জঙ্গিদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে, আর কেড়ে নিয়েছে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার।
সামরিক ও স্বৈরশাসকের হাতে ধর্মীয় ও অগণতান্ত্রিক বিধানগুলো সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর পরিহাস হলো জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই সেগুলো নতুন করে বৈধতা পেল।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.