বস্তি উচ্ছেদ-‘জীবন আমাদের নয়?’ by ফারুক ওয়াসিফ

বছরের প্রথম কালবৈশাখীর আগে আরেকটা ঝড় এসেছিল করাইল বস্তির তিন লাখ মানুষের জীবনে। অথচ উচ্ছেদ নয়, রাস্তার অবরোধই ছিল শুক্রবারের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকার প্রধান খবর। করাইল বস্তির অধিবাসীরা অবরোধ না করলে এ খবর পিছলে কততম পাতার কততম কলামে কত ইঞ্চি জায়গা পেত, তা অনুমেয়।


সাংবাদিকেরাও মানুষ এবং তাদেরও শ্রেণী আছে, আছে শ্রেণীজাত উপেক্ষা ও মনযোগ। নিজেদের সামাজিক অবস্থানের ভারে তাই খবরের ভরকেন্দ্র থেকে গরিব মানুষরা উচ্ছেদ হয়ে নাগরিক ভোগান্তি চলেআসে। বস্তিবাসীরা তাহলেঅনাগরিক? উচ্ছেদের উত্তাপ যারা পায়নি, তার পোড়ানি তাদের পোড়াবে কী করে? বুলডোজারের সামনে করজোড়ে মিনতি করা বস্তিবাসীর ফরিয়াদ তাদের কানে পৌঁছায়নি। সরকার পাথরের, বুলডোজার লোহার; সংবাদমাধ্যমও কি কাগজের মতো শুষ্ক আর ক্যামেরার মতো যান্ত্রিক? কিন্তু সবার অশ্রুই সমান নোনা, কারও কান্নাই মিষ্টি বা তিতা তো নয়!
এই লৌহ-শুষ্ক-যান্ত্রিক মনকে আমরা বস্তি উচ্ছেদের ক্ষমতার পেছনেই হাঁটতে দেখি, উদ্বাস্তু মানুষ ও তাদের মানুষী শিশুদের ঝড়বৃষ্টিতে আশ্রয়ের খোঁজে পাখির মতো ছোটাছুটির পেছনে তারা সময় নষ্ট করেনি। কারণ, তাঁদের যুক্তি ও আধুনিকতার অহং। গত শতকে দুটি যুক্তির মারণাস্ত্র আবিষ্কার করেছিল পশ্চিমা পুঁজিবাদ: আধুনিকতা ও উন্নয়ন। এই আধুনিকতা ও উন্নয়নের পালকিধারীদের মনে যে নগরপ্রতিমার বাস, সেখানে বস্তিবাসী, গরিব ও ভবঘুরেদের ঠাঁই নেই। তারা সভ্যতার কলঙ্ক বিধায় কলঙ্কমোচনের স্বার্থে তাদের মুছে ফেলা যায়। কিন্তু কেন গ্রামছাড়া মানুষ শহুরে বস্তিতে আসতে আসতে মানবেতর ‘মফিজে’ পরিণত হয়, কোন আধুনিক কার্যকলাপ ও উন্নয়নবাদী অর্থনীতি তাদের তাড়িয়ে ঢোকায় বস্তি নামক খোঁয়াড়ে, তার খোঁজ কে রাখে? আর এই খোঁয়াড় অবধারিতভাবে পুড়বে অথবা উচ্ছেদ হবে, এটাই নিয়তি? এই নিয়তি তারা মানছে না।গুলশানের অত্যাধুনিক উন্নয়নবাদী ফ্লাইওভারের নিচে মান্ধাতা আমলে আটকে রাখা মানুষদের উঠেআসা এই ‘উন্নয়ন’ আর ‘আধুনিকতার’ সংকটেরই প্রমাণ।
আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বস্তিজন্মের আসলকারণ জানেন বলেই চেপে যান এবং দরিদ্রদের শহরমুখী শরণার্থী যাত্রার কারণ দূর না করে, শহরকেই তাঁদের জন্য বন্ধ করে দিতে চান। তাই সম্পূর্ণ রঙিন আয়োজনে, মাথায় ফিতা বেঁধে বন্দুক ও বুলডোজারে সজ্জিত উচ্ছেদবাহিনী আসবার আগেই এর নীতি-পরিকল্পনা করেন উন্নয়নবাদী একদল নগর-বিশেষজ্ঞ, সংসদীয় কমিটি, বিশ্বব্যাংক-এডিবির প্রতিনিধিরা। কিংবা এর আলোকে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কলমের এক খোঁচায় লাখ লাখ বস্তিবাসীর কপাল পোড়ানোর নির্দেশে সই করেন। আদালতও তখন ‘দুই মাসের মধ্যে দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধারের নির্দেশে’ অ্যাকশন ঠিক করে দেন এবং ভুলে যান, ‘পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ নয়’—এই নির্দেশটাও আদালতেরই। প্রশাসনও ভুলে যায়, সরকারপ্রধানও উচ্ছেদ হবে না এমন প্রুতিশ্রুতি নির্বাচনের আগে দিয়েছিলেন। এভাবে বস্তিজীবনের পেছনের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যকারণ বেমালুম গায়েব করে দিয়ে, বাংলা সিনেমার হিরো বস্তির রাজা-রানিদের খলনায়ক-নায়িকা বানানো হয়। তারপর ঝোপঝাড় পিটিয়ে শেয়াল খেদানোর কায়দায় বস্তির ঝুপড়ি ভাঙার মহোৎসব চলে।
উচ্ছেদবাদীদের প্রধান যুক্তি বস্তিবাসীরা অবৈধ, তারা দখলদার। তাঁরা ভুলে যান, বস্তিবাসীরা বস্তির জমির মালিক নয়, জমির মালিক প্রায়শই সরকার, তা দখলে নিয়ে বস্তি পত্তন করে কোটি কোটি টাকা ভাড়া উসুল করেন সরকারি দলের নেতারা। এর ভাগ পুলিশ এবং প্রশাসনের লোকজনও পেয়ে থাকে। সংবিধান অনুসারে বাসস্থান পাওয়া সবার অধিকার। সেই অধিকার রাষ্ট্র দেয় না বলে নিজেরা যখন মাথার ওপর টিনের বা পলিথিনের চাল তোলে, রাষ্ট্র তখন সেই আশ্রয় কেড়ে নিতে পারে না। আর অবৈধ দখল উচ্ছেদের তালিকায় সবার আগে আসা উচিত হাতিরঝিলের ওপর বানানো গার্মেন্ট মালিকদের অশালীন ইমারত বিজেএমইএ ভবনের নাম।
দ্বিতীয় যুক্তি হলো, বস্তিবাসীরা মহানগরের উটকো, ফালতু, উচ্ছিষ্ট জনগণ। অথচ সরকারি হিসেবে ধরা না পড়লেও অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, জিডিপি’র ৩০ শতাংশই ইনফর্মাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি থেকে আসে এবং বস্তিবাসীরা তার চালক-বাহক। শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের বড় একটা অংশও বস্তিতেই থাকে। গার্মেন্টশিল্প, ইমারতশিল্পসহ চকচকে সব শিল্পের শ্রমিকেরা বস্তিতে থেকেই গতর খাটাতে যান। রিকশাওয়ালা, মুটে-মজুর, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বাসাবাড়ির কাজের লোকসহ সব রকম খুচরা পেশার লোকের আবাসও কিন্তু বস্তি। প্রতিদিন তাদের সেবা নিয়েই সংসার, নগর ও দেশ চলছে, অথচ তাদের বিরুদ্ধেই কিনা আমাদের এত আক্রোশ! লাভের গুড়টা খাবেন, আর গাদের মতো তাদের ফেলে দেবেন, তা হয় না। মানুষ ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ নয়।
তৃতীয় যুক্তি হলো, বস্তি অপরাধ ও মাদকের আখড়া। অপরাধের চুনোপুঁটিরা বস্তিতে থাকে বটে, কিন্তু তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। বাকিরা বৈধভাবে খেটেখাওয়া বঞ্চিত মানুষ। তা ছাড়া, দেশময় ঘটানো অপরাধের হোতারা, মাদকের গডফাদাররা, সন্ত্রাসী-নায়কেরা একজনও বস্তিতে থাকেন না, তাঁরা থাকেন সুরম্য অট্টালিকায়, অভিজাত ও সুরক্ষিত অঞ্চলে। পারলে আগে তাঁদের উচ্ছেদ করুন!
মধ্যবিত্ত সমাজের অপর বা বিপরীত চরিত্র হলো বস্তির সমাজ। শহুরে মধ্যবিত্তের গ্রাম নিয়ে কিছু জল্পনা-কল্পনা আছে, যা একদিকে সুন্দর রোমান্টিক আবার ভয়ংকর অবাস্তব। গ্রামের মানুষ অসভ্য, নোংরা, কাজিয়াপ্রবণ ইত্যাদি জল্পনার পাশাপাশি, মনের কোণে গ্রাম সম্পর্কে মায়াবী কল্পনাও কাজ করে। গ্রাম হচ্ছে প্রকৃতির লীলাভূমি, গ্রামের মানুষ সরল ও সৎ, গ্রামের জীবনে শান্তিতে সয়লাব ইত্যাদি। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের মন থেকে এই সুখকল্পনা দ্রুত হারিয়ে গেলেও, দুঃস্বপ্নটা অন্য রূপে ফিরে আসছে। বস্তির সামনে দাঁড়িয়ে দুঃস্বপ্নটা বরং আরও দাঁতালো হয়ে ওঠে। বস্তিকে যাবতীয় বদগুণের আধার ভাবা সেই মানসিকতারই অংশ। বস্তি তাদের কাছে কেবলই দৈহিক। গরিব মানুষকে দৈহিক অবয়বগত দিক দিয়ে বিচারে আরাম আছে। তখন, সেখানেও যে নর-নারী-শিশুদের সংসার আছে, পরিবার আছে, সমাজ আছে, তা চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে কেবল উটকো মানুষের স্তূপ আর কাঠ-বাঁশ-টিন আর পলিথিনের জঞ্জাল। জঞ্জালটা সরাতে তাই বিবেকের দংশন হয় না, আইনের সীমাটাও মনে থাকে না। তাই ২০ ফুট জায়গা মুক্ত করার নামে সমগ্র বসতিতে ভাংচুর চলে। এই বস্তুগত বিচারবোধ থেকেই করাইল বস্তিবাসীদের মাত্র দুই দিন সময় দেওয়া হয়। কিন্তু এক জায়গায় বসত গাড়া সংসার-পরিবার-সমাজ আরেক জায়গায় বসাতে কত বছর লেগে যায়, সেই ইতিহাস কে লিখবে? এই দায় কি কেবলবামপন্থিদের? এভাবে রাষ্ট্র অস্বীকার করে, স্বচ্ছলেরা বাতিল করে, গণমাধ্যম উপেক্ষা করে তাদের। জমি ও সুযোগ নিয়ে কামড়াকামড়ির এই শহরে বস্তি উচ্ছেদ তাই সম্পত্তিবানদের নতুন দখলের পাঁয়তারা।
এত এত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে বস্তিবাসীরা কী বলতে চায়, তা শুনতে সঙ্গের এই নির্বাক ছবিটিতে কান পাতুন। কোলে বাচ্চা, পেছনে ভাঙা সংসারের মামুলি হাঁড়িপাতিল-গামলা নিয়ে করজোড়ে তারা মিনতি করছে: জীবন আমাদেরো, এই জীবন নষ্ট কোরো না। ওই দুই নারীর অসহায় কান্না আর দয়াভিক্ষার করজোড়ের ভঙ্গিটুকুই তাদের জীবনের সারাসার। এত সামান্য জীবনের ঠাঁই যে সমাজে ও ব্যবস্থায় নেই, সেই সমাজের চলাচলের রাজপথে তাদের মানববন্ধন তাই ভীষণভাবেই মানবিক। বস্তিবাসীরা এই নৈরাজ্যময় নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক। তাহলেও করাইল বস্তির মাত্র ১৭০ একর জমিতে বসতি পত্তনের মাধ্যমে তারা নাগরিক-কমিউনিটি হয়ে উঠতে চায়। গ্রামের প্রতি সত্যিকার দরদ শহুরে রোমান্টিকদের থেকে তাদের শতগুণ বেশি। এই বিরান শহরে তারা আবার বানাতে চায় হারানো গ্রামের আত্মীয়সমাজ। শহর আর গ্রামের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে তারা দাবি করছে হারানো মানবতা আর হারানো ভূমির অধিকার। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান, অবরোধ সবই সেই জীবনবাদী জেদেরই প্রকাশ; অধিকারেরই দাবি। তাদের জীবন, তাদের বসতি আর তাদের প্রতিবাদ তাই আইনত, নৈতিকত এবং বাস্তবত বৈধ ও যৌক্তিক।
দলিত মানবতার ছবি গুয়ের্নিকা দেখে এক নাৎসি সেনাকর্মকর্তা শিল্পী পিকাসোকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি এটা বানিয়েছ’? উত্তরে পিকাসো বলেছিলেন, ‘না, আমি করিনি, তোমরাই এটা বানিয়েছ।’ বস্তিবাসীদের অমানবিকতা, ভাসমানতা, বসতিহীনতা আমাদেরই সৃষ্টি। ‘আমরা’ ‘তাদের’ আমাদের মতো জীবন দিতে না পারি, ‘তাদের’ বাঁচবার ও বসতি গাড়বার অধিকার অস্বীকার করতে পারি না।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.