চারদিক-শহীদ তারকেশ্বর ও তাঁর গৈলা গ্রাম by আলফ্রেড খোকন

অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্তর কথা বলতে গেলে তাঁর জন্মস্থান বরিশালের গৈলা গ্রামের কথা বলে নিতে হয়। যে গ্রামে জন্মেছিলেন ক্যামব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা ড. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, তাঁর কন্যা বিশিষ্ট সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী,


কবি মণীন্দ্র গুপ্ত এবং কলাপ ব্যাকরণ-এর ‘কাতন্ত্র পরিশিষ্ট’ শীর্ষক টীকার রচয়িতা ত্রিলোচন দাশ কবীন্দ্র এবং তাঁর ভাগনেয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ পদ্মপুরাণ রচয়িতা কবি বিজয় গুপ্তসহ প্রাচ্যের রাজনীতিক, ইতিহাসবিদ এবং শিল্প-সাহিত্যের প্রাজ্ঞজন। তা ছাড়া রাজনৈতিক ও মুক্তি আন্দোলনে গৈলা গ্রামের সুখ্যাতি ও যোগ্য অংশগ্রহণ বাংলাসহ ভারতবর্ষে আজও সুবিদিত।
গৈলা গ্রাম (আদি নাম—ফুল্লশ্রী, মানসী...) সম্পর্কে কবি বিজয় গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন—
‘পশ্চিমে ঘাঘর নদী, পূর্বে খণ্ডেশ্বর,
মধ্যখানে ফুল্লশ্রী, পণ্ডিতনগর,
স্থানগুণে যেই জন্মে সেই গুণময়
হেন নিবাসে জন্মে—শ্রী বিজয়।’
কবির ভাষ্যে, স্থানগুণের এই গুণীজন্মের গৈলা গ্রামে ১৯০৫ সালের ১৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী শহীদ তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন।
আনুমানিক ১৯২০ থেকে ২৫ সালের মধ্যে বরিশালের গৈলা গ্রামে তারকেশ্বর সেন ও তাঁর সতীর্থরা মিলে ‘গৈলা সেবাশ্রম’ (গৈলা শহীদ স্মৃতিসংঘ) গড়ে তোলেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও বৈপ্লবিক ভাবধারা সঞ্চার করা। লক্ষণীয় বিষয় এই যে গৈলা সেবাশ্রম পরিচালিত হতো শিবলিঙ্গ বা শিবপূজাকে কেন্দ্র করে। আশ্রমে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গকে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে তৎকালীন বিপ্লবী এই তরুণ দল বেছে নেয়। ধর্মাচার পালনের আড়ালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য, যাতে সহজে শাসকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। পাশাপাশি নৈশ বিদ্যালয়, পাঠাগারসহ নানা কৃষ্টিমূলক কাজকর্মও তাঁরা পরিচালনা করতেন। সে সময়ে গ্রামের সংখ্যালঘু মুসলিম যুবকেরাও এই সেবাশ্রমে যোগ দিয়ে অগ্নিযুগের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তৎপর ছিলেন।
তাঁদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি শুধু গৈলা কিংবা তৎকালীন পূর্ববঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতেও এর সামাজিক-রাজনৈতিক ও সশস্ত্র প্রভাব পড়ে এবং একপর্যায়ে ব্রিটিশ বাহিনীর রোষানলের স্বীকার হয়ে তরুণ তারকেশ্বর হিজলীতে অন্তরীণ হন। হিজলী ক্যাম্পে বন্দী থাকাকালে, বন্দিশিবির থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে একসঙ্গে পালাতে গিয়ে ব্রিটিশের পোষ্য পুলিশ বাহিনীর গুলিতে ১৯৩১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সান্ধ্যরাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। ওই স্থান আজও মর্মর ফলকে চিহ্নিত হয়ে আছে। স্থানটি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, খরাপুরের অন্তর্ভুক্ত। মর্মর পাথরে খোদিত অ্যাপিটাফে লেখা আছে:
‘হিজলী বন্দিশিবিরে ইংরেজ শাসকের গুলিবর্ষণে দেশের মুক্তিযজ্ঞে তোমাদের শৌর্যময় আত্মাহুতি শ্রদ্ধানত অন্তরে স্মরণ করি।’
তোমাদের গুণমুগ্ধ
স্বদেশবাসী।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে কংগ্রেস, বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে গৈলার বহুসংখ্যক যুবক-যুবতী স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্যাগ স্বীকার করেন। বিচারে বা বিনা বিচারে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কারারুদ্ধ বা অন্তরীণের সংখ্যাও প্রচুর। ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিপিনচন্দ্র পাল, পণ্ডিত মদন মোহন মালবীয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং স্বামী ভোলানন্দ গিরি, ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দ প্রমুখের মতো উজ্জ্বল ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে এই গ্রামে পদার্পণ করেন।
তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ গৈলায় আসেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা শহীদ তারকেশ্বর সেনের স্মৃতিচিহ্ন প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে গৈলায় এসেছিলেন।
ঐতিহ্যবাহী শিমুল ভাঙার খালের পাশে শতবর্ষের গৌরবে অধিষ্ঠিত গৈলা স্কুল প্রাঙ্গণে তাঁর সমাধিফলক আজও বিপ্লবের প্রতীকে স্বমহিমায় গৈলার গৌরব ঘোষণা করছে।
আলফ্রেড খোকন

No comments

Powered by Blogger.