ভোগান্তি-এ কোন দেশে আমরা আছি! by আতাউর রহমান

সরকারি চাকরিতে প্রবিষ্ট হওয়ার পর সুদীর্ঘ চার দশক দেশে ও বিদেশে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশ ও জনগণের সেবা করেছি। আর এটা করতে গিয়ে পৈতৃক ভিটেবাড়ি সংরক্ষণের প্রতি তেমন নজর দেওয়া হয়নি, যদিও একজন কেয়ারটেকারের মাধ্যমে যোগাযোগ ও যাতায়াত অব্যাহত ছিল।


বেড়া দিয়েছিলাম খেতের ধান রক্ষার্থে, কিন্তু সেই বেড়াই যে দুষ্ট গরুর সহায়ক হিসেবে কাজ করবে, সেটা বুঝতে পারিনি। যা হোক, চাকরির দিনগুলোতে যতটা পারি জন্মস্থানের হক আদায় করেছি—সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে ধরে আমার গ্রামের রাস্তাকে পাকা করে দিয়েছি, গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি, দেশে ও বিদেশে গ্রামের বেশ কিছু ছেলের চাকরির সংস্থানও করে দিয়েছি। পৈতৃক গ্রামের নাম নগর, ‘নগর’ অর্থ শহর। আমার গ্রামটি সত্যিকার অর্থেই এখন শহর।
জীবনের শেষ প্রান্তটা নাড়ি-পোঁতা জন্মস্থানে কাটানোর লক্ষ্যে সম্প্রতি গ্রামের বাড়িতে ঘর বানাতে গিয়ে লক্ষ করলাম, বাড়িতে আসা-যাওয়ার একসময়ের একমাত্র ও বর্তমানে বিকল্প রাস্তাটি এক দুষ্ট প্রতিবেশী, যার নিকটতম আত্মীয়কেও আমি সৌদি আরবে পোস্টিংয়ের সুবাদে সেখানে প্রায় নিখরচায় নিয়ে গেছিলাম, অন্যায়ভাবে দখল করে ফেলেছে। মহামতি ভলটেয়ারকে একজন লোক এসে যখন বলল, ‘অমুক আপনার ক্ষতির চেষ্টা করছে’, তখন তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘কেন? আমি তো তার কোনো উপকার করিনি!’ যা হোক, রাস্তাটি উদ্ধারকারী হিসেবে নৈতিক দায়িত্ব মনে করে মাঠে নেমে পড়ে যে দুর্লভ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সেটাই এখানে আমার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
ছেলেবেলায় দেখতাম, এরূপ ক্ষেত্রে গ্রাম্য বিচার-সালিসই মীমাংসার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এখন আর সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই; নেই সেই বাবরি মসজিদও। কিন্তু এ সত্ত্বেও গ্রামের দু-চারজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো তখন আইন-আদালতের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি রইল না। গোলাপগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খুব সজ্জন ব্যক্তি, কিন্তু তিনি তেমন কিছু করতে সক্ষম হলেন না। থানাদার সাহেবও কোর্টের অর্ডার ব্যতিরেকে হস্তক্ষেপ করতে রাজি ছিলেন না। অতএব শেষমেশ সিলেট জেলা সদরে অবস্থিত আদালতের শরণাপন্ন হতেই হলো। আদালত যথারীতি থানার তদন্ত রিপোর্ট চেয়ে পাঠালেন।
থানাদার কর্তৃক প্রেরিত তরুণ এসআই সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে ও সায়-সাক্ষী নিয়ে মৌখিকভাবে আমাকে আশ্বস্ত করলেও রিপোর্ট প্রদানকালে এ কী করলেন! কলমের এক খোঁচায় আমার বুনিয়াদি ১০০ বছরের পুরোনো রাস্তাকে সমঝোতার মাধ্যমে ‘এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ছিল’ বানিয়ে দিলেন। কিসের মাধ্যমে কী হয়েছে, সবই বুঝতে পেরেছি, কিন্তু খোলাখুলি বলতে পারছি না। এক বিচারক নাকি একবার রায়ে বলেছিলেন, ‘আমি আয়নায় আসামিকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে ধরতে পারছি না’ (I can see the accused in the mirror, but I can't catch him)।
আমি অবশ্য আমার আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিবেদনটির ওপর অনাস্থা জানিয়ে শুনানির পরবর্তী তারিখ অবগত হয়ে ঢাকায় চলে এসেছি এবং এখানে এসে সমপর্যায়ের সঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, তাদের প্রায় প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাও আমারই অনুরূপ। তো সেই দিন থেকে আমি ভাবছি, এ কোন দেশে আমরা আছি! আর এ-ই যদি থানা-পুলিশের চরিত্র হয়, তাহলে তাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন চেয়ে তাদের পকেট ভারী করে কী লাভ? বরং বিকল্প ব্যবস্থা প্রবর্তনের আশু প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, আগের দিনে যারা অপরাধ করত তাদের মধ্যেও একধরনের ‘এথিকস’ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আগের দিনে যারা ঢাকায় পকেটমার ছিল, তারা মানিব্যাগ থেকে পয়সাটা হাতড়ে নিয়ে জরুরি কাগজ থাকা মানিব্যাগটি স্ট্রিট লেটারবক্সে ফেলে দিয়ে যেত, যাতে করে মালিক সেটা ফেরত পেতে পারে। কিন্তু এখন আর তারা ওটা করে না। তেমনিভাবে থানার পুলিশ আগে নাকি এক পক্ষের কাছ থেকে টাকা খেত। এখন দুই পক্ষের কাছ থেকেই খায়। এর বিচার করবে কে, কখন, কোথায়?
বিবিসির হাসির অনুষ্ঠান ‘মি. বিন’-খ্যাত রোয়ান এটকিনসন যিনি লোকজনকে হাসান, হতাশায় ভুগে মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন মর্মে পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ। আমিও পত্রিকায় রম্যরচনার মাধ্যমে মানুষকে বিমল আনন্দদান তথা হাসানোর চেষ্টা করি, কিন্তু এখন নিজেই হাসতে পারছি না।
আতাউর রহমান: রম্যলেখক, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.