অগি্নঝরা একাত্তরের শব্দসংগ্রামী by ফকির আলমগীর

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বল্পুব্দ স্বর্ণকণ্ঠ দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর নেই। ৭৬ বছর বয়সে গত ২ জুন দক্ষিণ কলকাতায় নিজ বাড়িতে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কলকাতার লেক সার্কাস রোডের কালীবাড়ী এলাকার বাড়িতে চার বছর ধরে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন।


বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন আকাশবাণী কলকাতার জাদুকরী কণ্ঠ, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা ডাউনটাউন রোটারি ক্লাবের আমন্ত্রণে শেষবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন সম্ভবত ২০০৫ কিংবা ২০০৬ সালে। কলকাতার কবিতীর্থ রোটারি ক্লাব এ আয়োজনে সহায়তা করেছিল। ঢাকার বিয়াম মিলনায়তনে একজন শব্দসংগ্রামী হিসেবে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম। প্রথমে দর্শকসারিতে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের মালা দিয়ে সম্মান জানানো হয়। যমুনা ব্যাংক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সৌজন্যে অনুষ্ঠানে স্বর্ণকণ্ঠ শব্দসংগ্রামী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় উষ্ণ সংবর্ধনায় সিক্ত হন। ঢাকা ডাউনটাউন রোটারি ক্লাব বিয়াম মিলনায়তনে উষ্ণ সংবর্ধনার আয়োজন করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়। রোটারির শতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ এবং ব্যতিক্রম এ সম্মাননার আয়োজন করা হয়। তাকে দেওয়া হয় মানপত্র ও ৫৫ গ্রামের (২২ ক্যারেট) স্বর্ণপদক। তার স্ত্রী ও মেয়ের জন্য শাড়িসহ উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও শব্দসংগ্রামী দেবদুলালের জীবন ও অবদান নিয়ে ১৩ মিনিটের প্রামাণ্য চিত্রও নির্মাণ করা হয়েছিল ব্যতিক্রমী এ সংবর্ধনা উপলক্ষে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিল একাত্তরের গান। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগি্নঝরা একাত্তরের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে রক্তাক্ত সময়ের বহু ঘটনা। পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে আমার কৌতূহল ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলাম বাহাত্তর সালেই। খুব ইচ্ছা ছিল পূর্ববঙ্গ দেখব। কবি জসীমউদ্দীন আমাকে বলেছিলেন, চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশ দেখা সম্পূর্ণ হবে না। সে কারণে তখন চট্টগ্রামে বেড়াতে যেতে চাইলাম। বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান_ এখন চট্টগ্রামে যাওয়া যাবে না। সেখানে বিচ্ছিন্ন গোলাগুলি চলছে। কোনো রকম ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। স্মৃতিচারণায় কথাগুলো বললেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৭১ সালে বাঙালির জীবনের সবচেয়ে গৌরবময়, সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার গভীর, আবেদনময় ও আবেগময় কণ্ঠ ভেসে আসত আকাশবাণী কলকাতা থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংবাদ পাঠ, সংবাদ পর্যালোচনা, ধারা বর্ণনা অপরিসীম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের, অবরুদ্ধ দেশবাসীকে। সেই স্বর্ণকণ্ঠ শব্দসংগ্রামী উষ্ণ সংবর্ধনার জবাবে বলেন, আমি ভালো বক্তা নই। একাত্তরে যা বলেছি, তা একা ঘরে বসে বলেছি। জনসমক্ষে ভাষণ দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিব নিহত হওয়ার আগে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। 'শোন একটি মুজিবরের থেকে' স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুরকার ও গায়ক অংশুমান রায় এবং কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে আমাকে ও প্রণবেশ সেনকে 'বঙ্গবল্পুব্দ স্বর্ণপদক' দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ সে পদকটি দেখে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ভারি সুন্দর পদক হয়েছে সেটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পদক দেওয়ার আগেই বঙ্গবল্পুব্দ নিহত হন। সে ঘটনার পর দুর্ভাগ্যতাড়িত মানুষের কাছে আসার আকাঙ্ক্ষা আমার দূর হয়ে যায়নি। তাই এ সংবর্ধনা নিতে আসা। এ কথাগুলো শুনে আমার বারবার মনে পড়ছিল কণ্ঠশিল্পী অংশুমান রায়ের কথা। তিনিও একবার কলকাতায় বঙ্গবল্পুব্দ স্বর্ণপদক প্রসঙ্গে এ কথাগুলো বলেছিলেন।
১৯৮৭ সালে আমার কলকাতা সফরের সময় আকাশবাণী কলকাতায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর অংশুমান রায়ের সঙ্গে তার বাসায় সাক্ষাৎ হয়। অংশুমান রায় বঙ্গবল্পুব্দ স্বর্ণপদক প্রসঙ্গে তার প্রত্যাশার কথা আমাকে বলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এর কিছুদিন পর অজ্ঞাত কারণে রহস্যজনকভাবে অংশুমান রায় তার বাসভবনে আত্মহত্যা করেন। এরপর দু-দু'বার মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় এলেও খোঁজ নেওয়া হয়নি এবং সম্মান জানানো হয়নি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের গায়ক অংশুমান রায়কে। আর এবার যখন সরকার স্বাধীনতাসংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য বিদেশি নাগরিকদের সম্মান জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে, এর আগেই চলে গেলেন সবার প্রিয় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। যা হোক, ওই সংবর্ধনা সভায় আমার সঙ্গে কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজ ছিলেন। তার কাছে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের উজ্জ্বল স্মৃতি তুলে ধরি। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানে আমাকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন, লিখেছিলেন 'বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের জন্য একজন সামান্য ব্যক্তি হিসেবে আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।' আমি মঞ্চে উঠে তাকে একাত্তরের অটোগ্রাফ এবং তার সঙ্গে তোলা ছবি দেখাই। তিনি এসব দেখে নস্টালজিক হয়ে যান। আমাকে আশীর্বাদ করেন। এরপর সংবর্ধনা শেষে তাকে ধরে মঞ্চ থেকে নামানোর দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল আমার। দর্শকসারিতে বসা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে দেবারতি বন্দ্যোপাধ্যায়সহ কলকাতার কবিতীর্থ রোটারি ক্লাবের আমন্ত্রিত অতিথিদের পাশে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে বসিয়ে তার কাছ থেকে এবার বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে কিংবা কতবার তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, বাংলাদেশে এলে তার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় স্বদেশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে আসি। তখন ১০-১৫ দিন ছিলাম। এরপর শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলাম। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার গিয়েছি সেবার। এবারও গিয়েছি। তবে অনেক পরিবর্তন চোখে পড়েছে। যাক সে প্রসঙ্গ, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি; সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, আকাশবাণীতে, ঢাকায়, কলকাতায়। ১৯৯৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে সমর দাসের নেতৃত্বে একজন শব্দসংগ্রামী হিসেবে যোগদানের সুযোগ ঘটে। তখন তার বাসায় গিয়ে দেখা করি। আমার লেখা বই উপহার দিই। এ ছাড়া ১৯৯৭ সালে ২-৩ ডিসেম্বর কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে শওকত ওসমানের নেতৃত্বে অংশ নেওয়ার সুযোগ ঘটে। সে উৎসবে সংবর্ধনা জানানো হয় ত্রিগুণা সেন, গৌর কিশোর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, বিমান বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, গৌরী আইয়ুব, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন তরফদার, প্রণবেশ সেনসহ অনেককে। তখনও আমার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সানি্নধ্যে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। পরিশেষে ১৯৭১ সালে বিজয় দিবসের আগে আমাকে দেওয়া অটোগ্রাফ এখানে তুলে ধরছি।

ফকির আলমগীর : শব্দসংগ্রামী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
 

No comments

Powered by Blogger.