মাদকাসক্তি-বাড়ন্ত চারাগাছের কথাও ভাবুন by মোঃ মাসুদ পারভেজ রানা

মড়কে ধরা বৃক্ষের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের বাড়ন্ত চারাকে কীভাবে মড়কমুক্ত রাখব তার চেষ্টা করাও জরুরি। মাদকাসক্তদের নিরাময় জরুরি, তার চেয়েও জরুরি হলো মাদকাসক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা জরুরি। সংক্ষেপে আবারও বলতে চাই, এই মহৎ কর্মের জন্য আমাদের শিক্ষক সমাজ ও মা-বাবাই যথেষ্ট।


আমরা যদি সবাই আমাদের সন্তানদের দৈনন্দিন চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে অধিকসংখ্যক নিরাময় কেন্দ্র, সুবিশাল ভবন, অস্ত্রধারী কর্মকর্তা, আধুনিক সরঞ্জামাদি ইত্যাদির প্রয়োজন হবে না


দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি। বিষয়টি উদ্বেগের! আরও হতাশা প্রকাশিত হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্র্রতিক উক্তিতে। মাদকবিরোধী দিবসে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে 'সন্ত্রাস ও মাদক প্রতিরোধে আমাদের করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, 'বস্তিবাসী থেকে বিত্তশালী সবাই মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।' আসলে তার বলা উচিত ছিল, 'বস্তিবাসী থেকে বিত্তশালী অনেকেই মাদক সেবন ও ব্যবসায় জড়িত।' যাই হোক, তার উক্তি অন্তত এটুকু ইঙ্গিত করে যে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক লোকই মাদকের সঙ্গে যেভাবেই হোক না কেন জড়িত আছে। অশিক্ষিত লোকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। ওই শিক্ষিত এবং বিত্তশালী লোকগুলো কারা এবং কোন ধরনের শিক্ষা পেয়েছে? আদৌ কি তাদের শিক্ষিত বলা যায়? আমাদের শিক্ষার একি হাল! আমাদের বিত্তশালীদের সাংস্কৃতিক চেতনার এ কোন বিকৃত রূপ!
সম্প্রতি ফ্যান্টাসি কিংডমে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বেরসিক হানায় যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো হতাশাজনক। যেসব বিশিষ্ট শিল্পী ও তরুণ-তরুণী নৃত্যগীতে মাতোয়ারা আর মদ্যপ অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছে বা পালিয়ে গেছে এরাইবা কারা? এদের মা-বাবা কি জানতেন তাদের সন্তানরা রাতভর কোথায় আছে? এদের কাছ থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী শিক্ষা নেবে! ফ্যান্টাসি কিংডমের মতো জায়গায় যদি এসব হয় তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম নির্মল বিনোদনের জন্য যাবেই-বা কোথায়! এটা কি তাহলে আধুনিকতার কলুষ প্রত্যাঘাত!
মন্ত্রীর উক্তিতে, মাদকবিরোধী অভিযানের উল্লেখযোগ্য একটি উদ্যোগ হলো : দেশে যে ১০০টি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে তার সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। পাঠক আপনারাই বলুন, এটা কি কোনো ভালো উদ্যোগ? তিনি যদি বলতেন, দেশে ১০০টি নিরাময় কেন্দ্র ছিল, তার ৫০টি আমরা ইতিমধ্যে বন্ধ করে মাদকাসক্তদের কম্পিউটার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি; তাহলে অবশ্যই আমরা খুশি হতাম। দেশে নিরাময় কেন্দ্র বাড়ানো মোটেই সুখকর খবর নয়। আমরা চাই আর একটি নিরাময় কেন্দ্র যেন না থাকে।
বর্তমান মাদকবিরোধী অভিযানকে আরও গতিশীল করার জন্য রাজধানীসহ সারাদেশে ক্রমবর্ধমান মাদক আগ্রাসন মোকাবেলায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। মাদকবিরোধী অভিযানে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র বহনের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত জনবল রয়েছে ্এক হাজার ২৮৩ জন। তাদের মধ্যে সরাসরি অভিযানের সঙ্গে জড়িত থাকে মাত্র ৬৫৯ জন। উল্লেখ্য, এই সীমিত সংখ্যক লোক নিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কার্যক্রম চলছে। এছাড়া এরই মধ্যে ২৫০ জন নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে (২৩ জুন, ২০১১, সমকাল)। একই সভায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, পরনির্ভরশীল হয়ে কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে ফলপ্রসূ অবদান রাখা সম্ভব নয়। অনেক সময় পুলিশের সময়োচিত সহযোগিতার অভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরা যায় না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ৫-৬ হাজার জনবল ছাড়া স্বাভাবিকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। এছাড়াও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর মধ্যে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে ৩৮৮টি ওয়াকিটকি, ১৭টি ল্যাপটপ, ৯৬টি কম্পিউটার, ১০০টি ইউপিএস, ৬৪টি লেজার প্রিন্টার, ৬১টি স্ক্যানার, ৪০টি ফ্যাক্স মেশিন ও ৪০টি ফটোকপিয়ার দেওয়া হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে এগুলো ভালো উদ্যোগ। আমরা এ উদ্যোগের সাফল্য চাই। কিন্তু একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, এসব উদ্যোগকে আমার কাছে মনে হয় যেন পাতায় মোড়ক ধরা একটি ভয়ঙ্কর বৃক্ষকে নিরাময়ের মতো। মাদক ও মাদকাসক্ত নামের এ বৃক্ষটি যদি এত ভয়ঙ্কর হয়, আমরা তাকে সমূলে উৎপাটন করছি না কেন! আমি বুঝি না কেনইবা মোড়ক খাওয়া ওই পাতাগুলো নিরাময়ের জন্য এত আধুনিক ব্যবস্থা, সুউচ্চ ভবন, অস্ত্রধারী জনবল ইত্যাদি!
আমাদের উচিত হবে আগামী প্রজন্মকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। যারা মোড়কে রোগাক্রান্ত, তাদের পরিচর্যার পাশাপাশি আরও বলিষ্ঠভাবে প্রয়োজন তাদের শনাক্ত করা, যারা ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন মাদকাসক্তের কারণ উদ্ঘাটন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন মুমূর্ষু মাদকসেবীদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে গবেষণা করা। যেমন ধরুন, মাদকাসক্তির বিভিন্ন পর্যায় নিরূপণ করে, তার লক্ষণগুলো লিপিবদ্ধ করা। এই অনুযায়ী মাদকসেবীদের মা-বাবা এবং শিক্ষাঙ্গনে অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদেরও সজাগ করানো প্রয়োজন। আমরা প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি, মাদকসেবীর মা-বাবা স্বেচ্ছায় সন্তানকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ওই মা-বাবা যদি আগে থেকেই সজাগ থাকতেন, তাহলে এমন অবস্থা কখনও হওয়ার কথা নয়।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাদক সেবনের হার অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা যদি বিশেষ ভূমিকা রাখেন, তাহলে অনেক ছাত্রছাত্রীকেই মাদকাসক্তির এই বীভৎস থাবা থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমি মনে করি, একজন শিক্ষকের জন্য ক্লাসে অমনোযোগী ও মাদকসেবী ছাত্রছাত্রী খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়। তাছাড়া বেশি মাত্রায় মাদকাসক্ত হওয়ার আগেই তাদের সৎ পরামর্শ দিয়ে পড়ার টেবিলে নিয়ে আশা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ মাদকাসক্ত ছাত্রছাত্রীর মা-বাবারাও সাহায্য নিতে পারেন। অন্তত তাদের বিভাগ থেকে জানানো যায় এই বলে যে, তাদের সন্তান নিয়মিত পড়াশোনা করছে না বা মাদকসেবী বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজের অংশ হিসেবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সব শিক্ষকেরই করা উচিত বলে আমি মনে করি।
আবার সাধারণভাবে একটি ধারণা হলো, যেসব ছাত্রছাত্রী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের মধ্যে হয়তোবা মাদকসেবীর হার বেশি। এটি যদি সত্য হয়, তাহলে রাজনৈতিক দল থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মাদকসেবীদের নেতা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, এমনকি দলের সদস্যপদও বাতিলযোগ্য। হয়তো কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সংবিধানে এমন নীতিমালার উল্লেখ আছে। আসল কথা হলো তার ফলপ্রসূ প্রয়োগ। আমরা এরই মধ্যে আগামী প্রজন্মের যোগ্য রাজনীতিবিদের সংকট লক্ষ্য করছি। তারপরও যারা রাজনীতিতে যাবেন, ভবিষ্যতে এমপি হয়ে আইন প্রণয়ন করবেন, তাদের সিংহভাগই যদি মাদকসেবী হয় তাহলে দেশের অবস্থা কী হবে চিন্তা করে দেখুন!
আমাদের উচিত হবে, মড়কে ধরা বৃক্ষের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের বাড়ন্ত চারাকে কীভাবে মড়কমুক্ত রাখব তার চেষ্টা করাও জরুরি। মাদকাসক্তদের নিরাময় জরুরি, তার চেয়েও জরুরি হলো মাদকাসক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা জরুরি। সংক্ষেপে আবারও বলতে চাই, এই মহৎ কর্মের জন্য আমাদের শিক্ষক সমাজ ও মা-বাবাই যথেষ্ট। আমরা যদি সবাই আমাদের সন্তানদের দৈনন্দিন চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে অধিক সংখ্যক নিরাময় কেন্দ্র, সুবিশাল ভবন, অস্ত্রধারী কর্মকর্তা, আধুনিক সরঞ্জামাদি ইত্যাদির প্রয়োজন হবে না। এ প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হলে আপনাআপনি মাদক ব্যবসাও দূর হয়ে যাবে। আসুন আমরা সবাই আরও চিন্তাশীল হই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করি, আর মাদককে 'না' বলি।

মোঃ মাসুদ পারভেজ রানা : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
mmprana@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.